আজ আমরা একটি গল্প বলব যার নাম ব্যাঙের রাজা। এটি সুকুমার রায়ের বাছাই করা সেরা গল্প বই থেকে ব্যাঙের রাজা গল্প টি। চলুন শুরু করা যাকঃ-
ব্যাঙের রাজা গল্প
রাজবাড়িতে যাবার যে পথ, সেই পথের ধারে প্রকাণ্ড দেয়াল, সেই দেয়ালের একপাশে ব্যাঙেদের পুকুর। সোনাব্যাং, কোলাব্যাং, মেঠোব্যাং-সকলেরই বাড়ি সেই পুকুরের ধারে। ব্যাঙেদের সর্দার যে বুড়ো ব্যাং, সে থাকে দেয়ালের ধারে, একটা মরা গাছের ফাটলের মধ্যে, আর ভোর হলে সবাইকে ডাক দিয়ে জাগায়— “আয় আয় আয়—গ্যাক গ্যা গ্যা—দে দে দেখ—ব্যাং ব্যাং ব্যাং–ব্যাঙাচি।
এই বলে সে অহংকারে গাল ফুলিয়ে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আর ব্যাংগুলো সব “যাই যাই যাই—থা থাক্ থা” বলে, ঘুম ভেঙে, মুখ ধুয়ে দাঁত মেজে, পুকুরপারের সভায় বসে।
একদিন হয়েছে কি, সর্দার ব্যাং ফুর্তির চোটে লাফ দিয়েছে উলটোমুখে ডিগবাজি খেয়ে আর পড়বি তো পড়, এক্কেবারে দেয়াল টপকে রাজপথের মধ্যিখানে! রাজা তখন সভায় চলেছেন, সিপাই-শান্ত্রী লোকক্ষর দলবল সব সঙ্গে চলেছে। মোটা মোটা সব নাগরাই জুতো খটমটু ঘাচি করে ব্যাং বুড়োর মাথার উপর দিয়ে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছে এমনি রোখ ক’রে চলতে লেগেছে যে ভয়ে ব্যাঙের প্রাণ তো যায় যায়!
হঠাৎ কোথেকে কার একটা লাঠি না ছাতা না কিসের গুতো এসে এমনি ধাই করে ব্যাঙের গায়ে লেগেছে যে সে বেচারা ঠিকরে গিয়ে পথের ধারে ঘাসের উপর চিৎপাত হয়ে পড়েছে।
ব্যাং বুড়োর খুব লেগেছিল, কিন্তু হাতও ভাঙেনি, পাও ভাঙেনি, সে আস্তে আস্তে উঠে বসল।–আর চারদিকে তাকিয়ে, দেয়ালের গায়ে একটা ফাটল দেখে, তাড়াতাড়ি তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে খুব সাবধানে মুখ বার করে সে চেয়ে দেখল, মাথায়-মুকুট রঙিন-পোশাক রাজা, আলো-ঝলমল চতুর্দোলায় চড়ে সভায় যাচ্ছেন। লোকেরা সব “রাজা, রাজা” বলে নমস্কার করছে, নাচছে, গাইছে আর ছুটোছুটি করছে। আর রাজামশাই চতুর্দোলায় ব’সে খুশি হয়ে এর দিকে তাকাচ্ছেন, ওর দিকে তাকাচ্ছেন, আর কেবলি হাসছেন।
তাই দেখে ব্যাঙের বড় ভালো লাগল, সেও দুহাত তুলে নমস্কার করতে লাগল আর বলতে লাগল, ‘রাজা রাজা রাজা রাজা রাজা রাজা?” তার মনে হল রাজামশাই ঠিক তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন! ব্যাং তখন কাদ কাদ হ’য়ে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, “আহা! আমাদের যদি একটা রাজা থাকত!”
তারপর ঘুরে ঘুরে পথ খুঁজে খুঁজে ব্যাং যখন বাসায় ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
সবাই বলল, “সর্দার বুড়ো, সর্দার বুড়ো, সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমরা যে কত ডাকলাম, কত খুঁজলাম, তুমি তো কই সাড়াও দিলে না।”
সর্দার বলল-“চো চো চোপ্ রাও! রাজা দেখতে গিয়েছিলাম।”
তাই শুনে ব্যাঙেরা সব একসঙ্গে “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” বলে চেঁচিয়ে উঠল।
বুড়ো তখন গাল ফুলিয়ে, বুক ফুলিয়ে, দু’চোখ বুজে, দু’হাত তুলে লাফিয়ে বলল, “রাজা হচ্ছে এই এত্তো বড়ো উঁচু, আর ধবধবে সাদা আর ঝকঝকে আলোর মতো—আর তাকে দেখলেই সবাই মিলে ডাকতে থাকে—রাজা রাজা রাজা রাজা।”
তাই শুনে ব্যাঙেরা সবাই বলতে লাগল, “আহা! আহ! আমাদের যদি একটা রাজা থাকত!”
তাদের যে রাজা নেই, এই কথা ভাবতে ভাবতে তাদের চোখ দিয়ে ঝরঝর ক’রে জল পড়তে লাগল।
বুড়ো ব্যাং বলল,“ভাই সকল, এস আমরা রাজার জন্য দরখাস্ত করি।”
তখন সবাই মিলে গোল হলে বসে, আকাশের দিকে চোখ তুলে, নানা সুরে ডাকতে লাগল—“রাজা রাজা রাজা রাজা—রাজা রাজা রাজা রাজা—রাজা চাই, রাজা চাই, রাজা চাই, রাজা চাই, রাজা চাই।”
ব্যাং পুকরের ব্যাং দেবতা যিনি বাদলা দিনে বর্ষা মেঘের ঝাঝরি দিয়ে পুকুর ভরে জল ঢালেন- তিনি তখন আকাশতলায় চাদর মেলে ঘুমচ্ছিলেন। হঠাৎ ব্যাঙেদের চিৎকারে তার ঘুম ভাঙল। তিনি চারিদিকে তাকিয়ে বললেন, “বৃষ্টিও নেই, বালাও নেই, মেঘের কোনো চিহ্নও নেই, বাছারা সব চেঁচাও কেন?”
ব্যাঙেরা বলল, “আমাদের রাজা নেই, রাজা চাই।”
দেবতা বললেন, “এই নে রাজা।” এই বলে মরা গাছের একখানা ডাল ভেঙে তাদের সামনে ফেলে দিলেন। ভাঙা ডাল পুকুরপাড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তার মাথার উপর মস্ত মত্ত ব্যাঙের ছাতা জোছনায় চক চক করতে লাগল। তাই দেখে ব্যাঙের ফুর্তি আর ধরে। তারা গোল হয়ে ঘিরে বসে মনের সুখে গাইতে লাগল—“রাজা রাজা রাজা রাজা-রাজা রাজা রাজা রাজা”
এমনি ক’রে দুদিন যায়, দশদিন যায়,
শেষটায় একদিন সর্দার ব্যাঙের গিন্নী বললেন,
“ছাই রাজা! কর্তা যে সেদিন রাজা দেখলেন, এর চেয়ে সে অনেক ভালো। এ রাজা নড়েও চড়েও না, এদিকেও দেখে না ওদিকেও দেখে না ছাই রাজা!”
তাই শুনে সবাই বলল,
“ছাই রাজা! ছাই রাজা নড়েও না চড়েও না, দেখে না শোনেও না ছাই রাজা!”
তখন আবার বুড়ো ব্যাং গাছের উপর চড়ে বলল, “ভাই সকল, এস আমরা দরখাস্ত করি—আমাদের ভালো রাজা চাই।”
আবার সবাই গোল হয়ে বসে আকাশপানে চোখ তাকিয়ে নানা সুরে ডাতে লাগল-“রাজা চাই? রাজা চাই! ভালো রাজা নতুন রাজা।”
তাই শুনে ব্যাং দেবতা জেগে বললেন, “ব্যাপারখানা কী? এই তো সেদিন তোদের রাজা দিলাম,এর মধ্যে আবার নতুন কী হল?”
ব্যাঙের বলল, “ও বুজা ছাই রাজ্জা! ও রাজা বিশ্রী রাজা ও রাজা নড়েও না চড়েও না–ও রাজা চাই না, চাই না, চাই না, চাই না, চাই না, চাই না”
ব্যাং দেবতা বললেন, “থাম তোরা থাম নতুন রাজা দিচ্ছি।” এই বলে, একটা বককে সেই পুকুরের ধারে নামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “এই নে তোদের নতুন রাজা।
তাই না দেখে, ব্যাঙেরা সব অবাক হয়ে বলতে লাগল, “বাপরে বাপ! কি প্রকাণ্ড রাজা!” চকচকে ঝকঝকে ধবৃধবে সাদা! ভালো রাজা! সুন্দর রাজা! রাজা রাজা রাজা।”
ব্যাঙের রাজা অর্থাৎ বকের তখন খিদে ছিল না, মাছ খেয়ে পেট ভরা ছিল, তাই সে কিছু বলল না; খালি চোখ মিট মিট করে একবার এদিকে তাকাল, একবার ওদিকে তাকাল, তারপর এক পা তুলে চুপচাপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
তাই দেখে ব্যাঙেদের উৎসাহ আর ধরে না, তারা প্রাণ খুলে গলা ছেড়ে গাইতে লাগল । সকাল গেল, দুপুর গেল, বিকেল হল, সন্ধ্যা হল—তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রি এল—তখন ব্যাঙেদের গান গাওয়া বন্ধ হল।
তার পরের দিন সকালবেলায় উঠে যেমনি তারা গান ধরেছে, অমনি বকরাজা এসে একটা গোবদামতন মোটা ব্যাঙে টপাস্ করে মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে।
তাই দেখে ব্যাঙেরা হঠাৎ কেমন মুষড়ে গেল তাদের রাজা রাজার গান একেবারে পাঁচ সুর নেমে গেল।
বকরাজা ব্যাংটিকে দিয়ে জলযোগ করে একটি ঠ্যাং মুড়ে ধ্যান করতে লাগলেন।
এমনি ক’রে এক-এক বেলায় এক-একটি করে ব্যাং ব্যাঙের রাজা’র (বক) পেটের মধ্যে যায়।
ব্যাং মহলে হৈচৈ লেগে গেল। সবাই মিলে সভায় বসে যুক্তি করে বলল,
“এটা বড় অন্যায় হচ্ছে। রাজাকে বুঝিয়ে বলা দরকার, সে হল আমাদের ব্রাজা, সে এমন করলে আমরা পালাই কোথা?”
কিন্তু বুঝিয়ে বলবে কে?
সর্দার গিন্নী বললেন,
“তার জন্য ভাবছিস কেন? এতে আর মুশকিলকিসের? এই দেখ না, আমিই গিয়ে
বলে আসছি।”
সর্দার গিন্নী বকরাজার পায়ের সামনে গ্যাট হয়ে বসে হাত-মুখ নেড়ে কড়কড়ে গলায় বলতে লাগলেন, “ও রাজা, তোর ভাগ্যি ভালো, তুই আমাদের রাজা হলি ।
তোর চোখ ভাললো, মুখ ভালো, ঝকঝকে রঙ ভালো, দুই পা-ও ভালো,
কেবল ঐ টি তোর ভালো নয়,—তুই আমাদের খাস কেন?
শামুক আছে শামুক খানা, পোকা মাকড় প্রজাপতি তাও তো তুই খেতে পারিস।
রাজা হয়ে আমাদের খেতে চাস? ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছা—রাম রাম রাম রাম—অমন আর কক্ষণো করিসনে।”
বক দেখলে তার পায়ের কাছে দিব্যি একটা নাদুসনুদুস ব্যাং, তার নরম নরম গোলগাল চেহারা! টপ ক’রে বকরাজার জিভ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল আর খপ করে সর্দার গিন্নী তার মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন!
ব্যাঙেদের মুখে আর কথাটি নেই। সবাই তাড়াতাড়ি চটপটু সরে বসে বড় বড় হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
পরে সর্দার ব্যাং রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, “পাজি রাজা! লক্ষ্মীছাড়া দুষ্টু রাজা!”
তাই শুনে সবাই একসূঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল,
“পাজি রাজা! দুই রাজা! চাই না চাই না চাই না চাই না রাজা চাই না, রাজা চাই না।”
ব্যাং দেব জেগে বললেন, “দূর ছাই! আবার কী হল?”
ব্যাঙেরা বলল,
“বাপরে বাপু! বাপরে বাপ! কী দুষ্টু রাজা’ নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও!”
তখন ব্যাং দেবতা হুশ করে তাড়া দিতেই বাজা পাখা মেলে উড়ে পালাল। আর ব্যাঙেরা সব বাসায় গিয়ে বলতে লাগল, “গ্যা গা গঁ—বাপ বাপ বাপ-
ছ্যা ছ্যা ছ্যা—রাজাটাজা আর কক্ষণো চাইব না।”