আইনের উৎস সমূহ এবং আইন কি এই নিয়ে আজকের আলোচনা। ইনশাল্লাহ আমরা বিস্তারিত জানতে পারব। চলুন শুরু করা যাক।
আইনের সংজ্ঞা (Definition of Law)
‘আইন’ শব্দটি ফরাসি শব্দ। ইংরেজিতে আইনকে বলা হয় Law. যার উৎপত্তি টিউটনিক ‘ল্যাগ’ (Lag) শব্দ থেকে। lag শব্দের অর্থ ‘স্থির বা অপরিবর্তনীয় ও সমভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং শাব্দিক অর্থে আইন বলতে কতিপয় নির্দিষ্ট নিয়মাবলির সমষ্টিকে বুঝায়।
এক কথায় বলা যায়, সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী যে কতগুলো নিয়মকানুন যা সকলের জন্যেই সমভাবে প্রয়োগ করা হয় তাকেই আইন বলে।
আইন ও আইনের উৎস (Law & Source of Law)
সার্বভৌম শক্তির অনুমোদনকেই আইনের একমাত্র উৎস হিসেবে অভিহিত করা হয়। কেননা, রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রথা বা রীতিনীতি বা ধর্মীয় অনুশাসন আইনে পরিণত হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আইনের প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে আইনের নিম্নোক্ত উৎসসমূহ লক্ষ্য করা যায়।
প্রথা (Custom) :
প্রথাই আইনের প্রাচীনতম উৎস। আচার-ব্যবহার বহুদিন ধরে প্রবর্তিত থাকলে প্রথায় পরিণত হয়। প্রাচীনকালে আইন সাধারণত প্রথামূলকই ছিল। তৎকালীন সমাজে প্রথার সাহায্যে দ্বন্দ্ব-মীমাংসার ব্যবস্থা করা হতো। কবে এবং কিভাবে প্রথার উদ্ভব ঘটেছিল তা অবশ্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় নি। তবে এটি নিশ্চিত যে ধর্মের ভয়েই হোক বা অপরকে অনুকরণ করেই হোক বা উপযোগিতার জন্যেই হোক তখন লোকে অধিকাংশ প্রথাকে মান্য করে চলতো। রাজনৈতিক অর্থে প্রথাকে আইন বলে গণ্য করা না গেলেও বর্তমানে প্রথা যে প্রবর্তিত আইনসমূহের অন্যতম প্রধান উৎস সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ধর্ম (Religion) :
মানুষের ওপর ধর্মের প্রভাব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে প্রথার পেছনে ধর্মীয় অনুমোদন ছিল। ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য ইত্যাদি মূল্যবোধ ধর্ম চিহ্নিত করেছে বলে প্রাচীন ও সভ্যযুগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় রীতিনীতি প্রভাব বিস্তার করে। সে কালে ধর্মীয় বিধানই রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে বিবেচিত হতো। বর্তমান যুগেও ধর্মীয় রীতিনীতিকে আইনরূপে গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানদের পারিবারিক আইন তাদের স্ব-স্ব ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। তাই বলা যায়, ধর্ম আইনের আরেকটি অন্যতম উৎস।
বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা (Scientific Discussion) :
আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা বা তাদের আইন বিষয়ক গ্রন্থাবলিও আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। অইনবিদনের আইন সংক্রান্ত মূল্যায়ন, আলোচনা, আইনের ব্যাখ্যা ইত্যাদি থেকে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় আইনের সন্ধান লাভ করে। বৃটেনের আইন ব্যবস্থায় কোক, ব্লাক স্টোন, আমেরিকার কেল্ট প্রমুখ আইনবিদদের অনেক অভিমতই আইনের মর্যাদা লাভ করেছে। ইসলামি আইনের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম গাজ্জালী, ইবনে রুশদ, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহম্মদ বিন হাম্বল (রাঃ) প্রমুখ ইসলামি চিন্তাবিদদের মূল্যবান আলোচনা ও অভিমত গুরুত্বসহকারে আইনের উৎস হিসেবে দেখা হয়।
বিচার বিভাগীয় রায় (Judicial Decision):
বিচারকালে বিচারক যদি প্রচলিত আইনের মাধ্যমে আদালতে উত্থাপিত মামলার নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হন তখন তিনি স্বীয় বুদ্ধি এবং মেধার সাহায্যে প্রচলিত আইনের সাথে সঙ্গতি বিধান করে আইনের একটা নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে মামলার রায় প্রদান করেন। বিচারকের এ নতুন ব্যাখ্যা অনুরূপ কোনো মামলার ক্ষেত্রে যখন অন্য বিচারকরা গ্রহণ করেন তখন তা আইনে পরিণত হয়ে যায়। তাই দেখা যায়, বিচারকের রায়ও আইনের একটি উৎস। এজন্যে গেটেল বলেন, “আইন প্রণেতা হিসেবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় নি, উদ্ভব হয়েছিল প্রথার ব্যাখ্যাকর্তা ও প্রয়োগকারী হিসেবে।
ন্যায় বিচার (Justice):
বিচারকগণের দায়িত্ব ন্যায় বিচার সম্পাদন করা। কিন্তু দেশে প্রচলিত আইনের সাহায্যে এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এসব ক্ষেত্রে বিচারপতিগণ ব্যক্তিগত ন্যায়-নীতির ধারণার ভিত্তিতে বিরোধের মীমাংসা করেন। আইনের সুস্পষ্ট নির্দেশের অনুপস্থিতিতে ন্যায় বিচার আইনের অসম্পূর্ণতা দূর করতে সাহায্য করে থাকে। হেনরি মেইন Equity-র সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “anybody of rules existing by the side of the original civil law, founded on distinct principles and claiming incidentally to supersede the civil law in virtue of a superior sanctity inhernet in those principles.”
আইন প্রণয়ন (Legislation) :
বর্তমান যুগে আইন হলো আইনের সর্বপ্রধান উৎস। গিলঞ্জি (Gilchrist) বলেছেন, “It is chief source of law and is tending to supplant the other sources. দেশের আইনসভা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে জনমত অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে। জনকল্যাণমূলক তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট রাষ্ট্রে সরকারের কর্মক্ষেত্রের পরিধি যথেষ্ট প্রসারিত হয়েছে। এ বিপুল দায়িত্ব সম্পাদনের জন্যে প্রয়োজন হয় অসংখ্য আইনের। আইনপরিবস এসব আইন সৃষ্টি করে।
নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্তি (Executive Order and Decree)
বর্তমান যুগে নানা কারণে আইনসভা তার কর্তৃত্বকে শাসন বিভাগের মাধ্যমেও পরিচালনা করে। এ অবস্থায় শাসন বিভাগের জারিকৃত ঘোষণা ও আদেশ আইনে পরিণত হয়। তাই শাসনিক আইনের উৎস নির্বাহী ঘোষণা ও ডিকি।
বৈদেশিক চুক্তি (Foreign Treaty)
সাধারণত বৈদেশিক চুক্তিগুলো শাসন বিভাগের যারা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রায় দেশেই বৈদেশিক চুক্তি ঘোষিত হওয়ার পর তা আইনসভায় গৃহীত হয়ে আইনে পরিণত হয়। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বৈদেশিক চুক্তি ঘোষিত হওয়ার আগেই আইনসভার অনুমোদন লাভ করতে হয়।
সংবিধান (Constitution):
সংবিধান আইনের সবচেয়ে বড় উৎস। সংবিধান আইনের বিশেষ দলিল। আইনসভা ও অন্যান্য সরকারি বিভাগের ক্ষমতা সীমিত ও তাদের কার্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে সংবিধান রচনা করা হয়। সংবিধানে জনগণের অধিকারসমূহ লিপিবন্ধ থাকে। সংবিধানে বিভিন্ন ধরনের বিধান আইনসভা ও সরকারের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। সংবিধান পরিপন্থী কোনো আদেশ-নির্দেশ আইনে পরিণত হতে পারে না। তাই সংবিধান মূলত আইন তৈরির প্রধান উৎস।
আন্তর্জাতিক আইন (International Law) :
বর্তমানে আইনের উৎস হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনকেও ধরা হয়ে থাকে। কারণ আন্তর্জাতিক আইন সুসভ্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ধারণ করে এবং রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। টি. জে পরে (T. J. Lawrence) বলেছেন, “আন্তর্জাতিক আইন বলতে সেসব বিধিবিধানকে বুঝায় যা সাধারণভাবে সুসভ্য রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে।”
জনমত (Public Opinion):
জনমত আইনের একট অত্যাধুনিক উৎস। আধুনিক বিশ্বে জনমতের ভিত্তিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণীত হয়ে থাকে। বর্তমানে আইনসভা জনমতকে উপেক্ষা করে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আবার আইনসভা কখনও কখনও আইন প্রণয়নের পূর্বে জনমত যাচাই করে আইন প্রণয়ন করে।
সংহতিকরণ (Integration) :
সংহতিকরণ আইনের একটি সহায়ক উৎস। আইন প্রণয়নের পর তা বিন্যস্ত করার প্রয়োজন পড়ে। এ বিন্যাসকরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে আইনের অসংগতি দূর করা। এ সময় আইনের কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তনের কারণে আবার নতুন নতুন আইনের সংযোজন হয়। এক্ষেত্রে সংহতিকরণ আইন প্রণয়নের উৎস হিসেবে কাজ করে।
আইনজ্ঞদের ভাষ্য (Comments of Lawyer):
অনেক আইনবিদদের রচনাবলিও আইনের উৎস হিসেবে কাজ করছে। তাদের ব্যাখ্যা ও আলোচনা আইনের প্রকৃত অর্থ, অভিপ্রায় ও মর্ম উদ্ঘাটন করে। এসব গ্রন্থে অনেক আইনগত নীতি থাকে, যেগুলো বিভিন্ন রাষ্ট্রে পরবর্তীতে আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন- বৃটেনের আইন ব্যবস্থায়ও কোক (Coke), ব্ল্যাকস্টোন (Blackstone). বেল্ট (Kent) প্রমুখ পণ্ডিতের ব্যাখ্যার বিশেষ অবদান রয়েছে।
প্রশাসনিক ঘোষণা ( Administrative Declaration):
অনেক সময় আইনসভা তার নির্বাহী কর্তৃত্বের বহুলাংশ শাসন বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে অর্পণ করে। তখন শাসন বিভাগের কর্মকর্তাগণ অর্পিত ক্ষমতাবলে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী ঘোষণা ও ডিগ্রি প্রদানের দ্বারা নতুন আইনের সৃষ্টি করেন।
পরিশেষ
উপর্যুক্ত আলোচনার নিরিখে বলা যায়, আইন নিছক কোন ধারণা নয় বরং দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন উৎসের সমন্বয়ে গড়ে ওঠেছে। বর্তমানে সংবিধান, আইনসভা আইনের অন্যতম উৎস হলেও প্রথা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং অন্য উৎসসমূহও আইন প্রণয়নে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। তাই আমরা রাষ্ট্রপতি উইলসনের সাথে একমত হয়ে বলতে পারি যে, “বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা দ্বারা আইনের সৃষ্টি সভ্যতার এক বিশেষ স্তরে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত আইনের উৎসরূপে গণ্য করা হয় না।”
আমাদের সাথেই থাকুন,
Nice