আন্তর্জাতিকতাবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। জাতীয়তাবাদের বৃহত্তম রূপই হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদ। আন্তর্জাতিকতাবাদের অনুপ্রেরণায় পৃথিবীর অনেক দেশই পৃথক জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধে আবদ্ধ হয়ে আছে ।
আন্তর্জাতিকতাবাদের সংজ্ঞা
আন্তর্জাতিকতাবাদ হচ্ছে জাতীয়তাবাদের আন্তর্জাতিক রূপ। আন্তর্জাতিকতাবাদ বলতে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে বিশ্বের সকল জনগণ একাত্ম ও মিলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সকল জাতিকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কিছু উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :
বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, “আন্তর্জাতিকতাবাদ হচ্ছে এমন একটি মানসিক পরিস্থিতি যেখানে জাতির সীমানা প্রায় এক না হলে সীমানা এক প্রকৃত আন্তর্জাতিকতা গড়ে ওঠে না।”
গোল্ডস্মিথ বলেন, “আন্তর্জাতিকতাবাদ এমন এক অনুভূতি যে, একজন ব্যক্তি শুধু একটি রাষ্ট্রের সদস্য নয়, কিন্তু বিশ্বের একজন নাগরিক।” (Internationalism is the feeling that the individual is not only a member of his state but a citizen of the world.)
Dictionary of social Science এর ভাষায়, “আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো এমন একটি মানসিক অনুভূতি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা যা মানব জাতির মধ্যে ঐক্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে ।
ড. এ. কে. মহাপাত্র বলেন, “আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো সাম্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে এক প্রীতিপূর্ণ বিশ্ব সমাজ প্রতিষ্ঠা। বৃহৎ, ক্ষুদ্র, সবল, দুর্বল নির্বিশেষে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা।”
উপসংহার
সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি এবং সকল জাতি রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্যের মিলবন্ধন সৃষ্টি করে। জাতীয়তাকে নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে রেখে বৃহত্তর এক জাতি-গোষ্ঠী তৈরি করে।
আন্তর্জাতিকতাবাদ কি বিশ্বসভ্যতার জন্য আশীর্বাদ না হুমকিস্বরূপ!! বিস্তারিত আলোচনা।
ভূমিকা
আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো বিশ্বের সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের অন্যতম ধারক ও বাহক। এটি মানুষের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সহ অবস্থানের কথা বর্ণনা করে। সকল মানুষ একক সমাজের অন্তর্ভুক্ত ও পরস্পর পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হয়। আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে এই নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতা আরো বেড়ে গেছে। সকল জাতিরাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। একবিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বের জনগণের মধ্যে আরো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে দেখা দিয়েছে। একদিকে যেমন মানুষে মানুষে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে নানান সংকট ও সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছে। আন্তর্জাতিকতাবাদ সভ্যতার জন্য বিশ্বের মানুষের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ নিম্নে এ সংক্রান্ত আলোচনা করা হলো
আন্তর্জাতিকতাবাদ কি সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ না হুমকিস্বরূপ!!!
ব্যাখ্যা :
আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বের মানুষের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণা থেকে জাতিসংঘসহ আরো অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংঘ গড়ে উঠেছে। যেসব সংঘ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিকতাবাশ সভ্যতার যেসব দিক উন্নয়নে অবদান রাখে তা নিম্নে সবিস্তারে আলোচনা করা হলো :
সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ
আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে বিশ্বের দেশগুলো তাদের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ করছে। এক্ষেত্রে UNESCO গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কারণ UNESCO বিশ্ব সংস্কৃতি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে থাকে। সেই সাথে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জিনিসগুলো সংরক্ষণের জন্য দেশগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা
আন্তর্জাতিকবাদের কারণে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর মানবাধিকার এর সনদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্বের দারিদ্র্য, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মানবাধিকার চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া Human Rights Watch, Amnesty International ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে থাকে।
আরও পড়ুনঃ- আইন ও আইনের উৎস সমূহ।
তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তির উন্নয়ন
আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তির উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটছে। ফলে বৈশ্বিক যোগাযোগ সহজ হয়েছে। কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট প্রভৃতির উন্নয়নের ফলে সভ্যতাসমূহের বিকাশ দ্রুত হচ্ছে। পাশাপাশি এসবের নেতিবাচক অবদানও লক্ষণীয়।
সাংস্কৃতিক আদান প্রদান
আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এক দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, অন্য দেশের মানুষ উপভোগ করতে পারছে। দেশীয় ভাষা, খাদ্যাভ্যাস এর সাথে বৈদেশিক ভাষা খাদ্যাভ্যাসের মিলন ঘটেছে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্ব পাচ্ছে এক নতুন মাত্রা।
আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা
আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে সংঘাতময় বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা সময় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা পরিলক্ষিত করে এর থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে ১৯১৯ সালে জাতিপুঞ্জ এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিকতাবাদের অন্যতম নিদর্শন। বর্তমান জাতিসংঘ, ইরাকযুদ্ধ, বসনিয়া সংকট, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধবন্ধসহ নানা ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। যদিও ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে তেমন কোনো অগ্রগতি সাধন করতে পারে নাই। তাই বলা যায়, আন্তর্জাতিকতাবাদ মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
আন্তর্জাতিক আইন ও আদালত প্রতিষ্ঠা
আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে বিভিন্ন চুক্তির দ্বারা আন্তর্জাতিক আইন ও আদালতের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অন্যতম যা পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া সমুদ্র আইন, আন্তর্জাতিক নদী আইন, মানবাধিকার আইন, UNHCR আইন প্রভৃতি অন্যতম। এসব চুক্তির মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠা অন্যতম। এই আদালতে অনেক যুদ্ধাপরাধী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে।
সন্ত্রাসবাদ দমন
একবিংশ শতাব্দীতে সন্ত্রাসবাদ এর উত্থান একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। মধ্যপ্রাচ্যে I.S-এর উত্থান, প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা, লন্ডন এ হামলা, ইসলামাবাদের বোমা হামলা, কাবুল এ বোমা হামলা, বাংলাদেশের হলি আর্টিজানে হামলা প্রভৃতি ঘটনাগুলো সন্ত্রাসবাদের উত্থানের ইঙ্গিত বহন করে। এই সন্ত্রাস মোকাবিলায় বিশ্ব সম্প্রদায় একাত্মতা প্রকাশ করেছে এবং তা মোকাবিলা করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি
আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। ১৯১৫ সালে WTO চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্যের প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই চুক্তির আওতায় উন্নত দেশগুলো বেশি সুবিধা ভোগ করলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ-সুবিধা ছাড়া দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিকতাবাদের উদাহরণস্বরূপ WTO-এর অবদান অনস্বীকার্য ।
সামাজিক উন্নয়ন
আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে সামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের UNDP প্রতিষ্ঠান বিশ্বে দেশগুলোর উন্নয়নের তদারকি করে থাকে। সমাজের মানুষের শিক্ষা, | স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধার তদারকি করে অনগ্রসর দেশগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা করে থাকে। ফলে বিশ্বের দেশগুলে সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নত হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন।
শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন
আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে UNICEF। বিশ্বের দেশগুলোর প্রদর চাঁদার কারণে প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন দেশে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে থাকে। তাছাড়া শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, নারী ও শিশু পাচার রোধকরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবদান রাখে। আন্তর্জাতিকতাবাদ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখে।
মাদক পাচার ও চোরাচালান রোধ
আন্তর্জাতিকতাবাদ মাদক পাচার ও চোরাচালান রোধে সহযোগিতা করে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের চুক্তির আওতাধীন দেশগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা রয়েছে। এই চুক্তির আওতায় এসব অবৈধ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
আন্তর্জাতিকতাবাদ ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখে। আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে দেশগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশগুলোর মধ্যে মূলধন বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক দেশ অর্থনৈতিক চুক্তির আওতায় শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করছে। ফলে আমদানি রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক দেশ দক্ষ মানব সম্পদ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে এসব সম্ভবপর হয়েছে।
পরিশেষ
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বের মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়, বরং আশীর্বাদস্বরূপ । কেননা, আন্তর্জাতিকতাবাদের কারণে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর উন্নয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে আন্তর্জাতিকতাবাদের সমালোচনা করে এটাকে হুমকিস্বরূপ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিছু সমালোচনা থাকলেও সার্বিক দিক | আশীর্বাদস্বরূপ কেননা ভ্রাতৃত্বের জয়গান গেয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদের থেকে আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বের জন্য নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে আন্তর্জাতিকতাবাদের শেষ।