ইবনে রুশদ – যিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক এবং তার পাশাপাশি তিনি একাধারে যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, গনিত, জ্যোতিবিদ্যা এবং রাষ্ট্রতত্ত্বে অবদান রাখেন। এমন কি তিনি কুরআন, হাদিস, ফিকহ, কালাম প্রভৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
জন্ম ও পরিচয়
ইবনে রুশদের পূর্ণ নাম আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মদ বিন আহমাদ ইবনে রুশদ। প্যাটিন ভাষায় তিনি অ্যাভেররোজ নামে খ্যাতি লাভ করেছেন। (১১২৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সভ্যতার ইউরোপীয় কেন্দ্র (কর্ডোভায় একটি বিখ্যাত কাজি, পরিবারে তার জন্ম হয়। তার পিতা ও পিতামহ উভয়েই কর্ডোতার কাজি পদে সমাসীন ছিলেন। তার পিতামহ আল-মুরাবীদ সুলতানের আমলে সারা আদালুসের কাজি উল ফুযযা বা প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষা জীবন
ইবনে রুশদ শৈশবেই শিক্ষার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। পারিবারিকভাবে তিনি ছিলেন গভীর শিক্ষানুরাগী একটি পরিবারের সদস্য। সে কারণে পরিবার থেকেই তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। তার অধ্যয়নের নেশা এতোই প্রবল ছিল যে, সত্তর বছর বয়সেও তিনি যোগ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। সে যুগের কোনো বিশিষ্ট গ্রন্থকারের গ্রন্থ তাঁর অপঠিত ছিল না। তিনি কুরআন, হাদীস, ফিকহ, কালাম, চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে রুশদ:
অন্যান্য প্রথম শ্রেণির দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদের মতো ইবনে রুশদও চিকিৎসা জগতে যথেষ্ট সুনামের অধিকারী। বিশেষত দার্শনিক-চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার আদর্শ ছিলেন। ইবনে রুশদ চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে বেশ কিছু প্রণিধানযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেন। ‘কুল্লিয়াত ফিত তিব’ তাঁর অমর রচনাবলির অন্যতম। এতে তিনি রোগ, রোগের সাধারণ লক্ষণ, রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সম্ভাব্য বিভিন্ন ঔষধ সম্পর্কে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও তথ্যসম্বলিত আলোচনা করেন। তিনি ভেষজ সম্পর্কে মোট ১৮ খানা বই লেখেন।
আইন বিজ্ঞানী ইবনে রুশদ
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতো আইন বিজ্ঞানেও ইবনে রুশদের অসামান্য প্রতিভার চূড়ান্ত বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পিতামহ ও পিতার পথ ধরে তিনিও এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১১৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেভিলের এবং ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে কর্ডোভার কাজি পদে নিয়োজিত হন। এ সময়ে একজন কৌশলী ও বিজ্ঞ আইনবিদ হিসেবে তাকে এতো অধিক ব্যস্ত থাকতে হয় যে, তার জ্ঞান সাধনার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে যায়।
আরও পড়ুনঃ- ইমাম গাজ্জালী
রাজকীয় হেকিম ইবনে রুশদ:
১১৬২ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে রুশদ মুয়াহীদ খলীফা আবু ইয়াকুব ইউসুফের আমন্ত্রণে মারাকেশ গমন করেন। সেখানে খলীফা তাকে রাজকীয় হেকিম এবং উজিরের পদ দিয়ে সম্মানিত করেন। এ সময় দার্শনিক-ধর্মতত্ত্ববিদ ইবনে তুফায়েলের বন্ধুত্ব খলিফার দরবারে তাকে পরিচিত করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। খলিফা আবু ইয়াকুরের মৃত্যুর পর আল-মানসুর খলীফা পদে অধিষ্ঠিত হন। ফলে তার সম্মান ও গ্রহণযোগ্য আরো বহুগুণ বেড়ে যায়।
ষড়যন্ত্রের কবলে ইবনে রুশদ
খলীফার দরবারে ইবনে রুশদের উচ্চ মর্যাদা ও বিশেষ সম্মান লাভ আমীর মহলে তাকে বিশেষ ঈর্ষার পাত্রে পরিণত করে। তিনি তাদের সকলের হিংসা, শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। দেশের ফকিহ ও আলিম সমাজ তার সুখ্যাতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে আরম্ভ করে। তারা ছড়াতে থাকে যে, ইবনে রুশন ইসলামে বিশ্বাস করে না এবং কুরআন মাজীদকে আল্লাহর কালাম মনে করে না। এ প্রচারণার ফলে দেশের আলিম সমাজ ও গোড়াপন্থী ধর্মতত্ত্ববিদগণ তাকে মুনাফিক সাব্যস্ত করে এবং তার ওপর ভীষণভাবে ক্ষেপে যায়। তাদের চাপে, প্রভাবে ও ক্রমাগত দাবির মুখে খলীফা শেষ পর্যন্ত ইবনে রুশদকে মারাকেশ ছেড়ে যাওয়ার অনুরোধ করতে বাধ্য হন। ফলে তিনি মারাকেশ ছেড়ে চলে যান। কিন্তু কিছুদিন পরেই খলীফা প্রকৃত সত্য অবহিত হন এবং তার সামনে ষড়যন্ত্রকারীদের কুটচাল স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে তিনি ইবনে রুশদকে আবারো দরবারে ফিরিয়ে আনেন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য আগের চেয়েও বেশি সম্মান ও ক্ষমতা দান করেন।
পরলোক গমন
ক্রমাগত পরিশ্রম, অব্যাহত জ্ঞানসাধনা, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন এবং বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা ইবনে রুশদকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে দেয়। তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে এবং ১১৯৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ৭২ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। মারাকেশে রাজকীয় সম্মানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
Beautiful