ক্রুসেড হলো প্রায় দুই শতকব্যাপী ইউরোপ কর্তৃক পরিচালিত সামরিক অভিযান। এর উদ্দেশ্য ছিলো মুসলিমদের হাত থেকে জেরুজালেম ছিনিয়ে নেওয়া এবং বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের বিজয় রথের গতিরোধ করা।
[এই কন্টেন্টের বেশীরভাগ অংশ নেওয়া হয়েছে মুহাম্মাদ আল আরুসির লেখা ‘আল হুকর আস-সালিবিয়্যাহ ফি-মাশরিক ওয়াল মাগরিব’কিতাব থেকে।]
ক্রুসেড এর কারণ।
ক্রুসেডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হলো:
১। জেরুজালেম এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের যেসব এলাকা খ্রিষ্টান শাসনাধীনে ছিলো, তা মুসলিমরা জয় করে ফেলায় খ্রিষ্টানদের মাঝে ঘৃণার আগুন জ্বলে ওঠে।
২। মুসলিম সেলজুকরা কন্সটান্টিনোপলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলো। মুসলিমদের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টান বিশ্বের সাহায্যের আবেদন করেন বাইজেন্টাইন সম্রাট অ্যালেক্সিয়াস কমনিনাস।
৩। জেরুজালেমের খৃষ্টান তীর্থযাত্রীরা মুসলিমদের পক্ষ থেকে খারাপ আচরণের অভিযোগ তোলে। ইউরোপে ফিরে তারা অভিযোগ করে যে মুসলিমদের কাছ থেকে তারা অনেক অবিচার ও হয়রানির শিকার হয়েছে। এভাবে খ্রিষ্টানদের মনে মুসলিমদের ব্যাপারে ঘৃণার বীজ বপনে সবচেয়ে তৎপরদের একজন ছিলেন ফ্রেঞ্চ সন্ন্যাসী পিটার দ্য হামিট।
৪। জেরুজালেমকে মুসলিমদের হাত থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে পাপমোচন করানোর ধর্মীয় চেতনা ছিলো ক্রুসেডারদের বড় এক উৎসাহের উৎস। যাজক, বিশপ ও পোপদের ভাষণে তা আরো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
৫। সেলজুক মুসলিমদের দখলকৃত এলাকাগুলো মুক্ত করতে মিশরের ফাতিমিরা বাইজেন্টাইনদের সাথে মৈত্রী করতে খুবই উৎসুক ছিলো।
ফ্রান্সে কাউন্সিল অব ক্লারমন্টে পোপ দ্বিতীয় আরবান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ৪৮৮ হিজরি মোতাবেক ১০৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করতে সম্মত হয়। সেই ভাষণে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ঘৃণা প্রকাশিত হয়। তিনি ঘোষণা করেন, “এই যুদ্ধ কেবল একটি শহর জয় করার যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ হলো সমগ্র এশিয়া জয় করে এর অপরিমেয় সম্পদ হস্তগত করা। আপনাদেরকে জেরুজালেমে তীর্থযাত্রায় গিয়ে একে দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। আপনাদেরকে এই ভূমি জয় করতেই হবে। কারণ তাওরাত ঘোষণা করেছে যে, এটি হলো প্রবহমান দুধ ও মধুতে ভরা শহর।”[আল আকবর আস-সুন্নিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ১২ ]
প্রথম ক্রুসেড ও জেরুজালেম দখল।
৪৮৬ হিজরিতে ফ্রেঞ্চ সন্ন্যাসী পিটার দ্য হার্মিট জেরুজালেম সফর করেন। দেশে ফিরে তিনি পোপের সাথে দেখা করে ক্রুসেডের ডাক দেওয়ার আহ্বান জানান। পোপ প্রথমে উত্তর ইটালির পিয়াকেজানে একটি সম্মেলন করেন। তারপরে ফ্রান্সে কাউন্সিল অব ক্লারমন্টের সম্মেলন হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় যুদ্ধ শুরু করার।
ক্রুসেডার সেনাবাহিনীগুলো কন্সটান্টিনোপলে মিলিত হওয়ার পরিকল্পনা করে। প্রথম বাহিনীটি ছিলো খুবই বিশৃঙ্খল ও এলোমেলো। এটি এশিয়া মাইনর পার হওয়ার পর সেলজুক কালিজ আরসালান তাদেরকে কন্সটান্টিনোপলের খুব কাছে নাইকিয়া শহরে মোকাবেলা করে পরাজিত করেন।
খাইরুদ্দিন বারবারোসা ও অষ্টম ক্রুসেড – হলি লিগ (১৫৩৮ সালের ক্রুসেড)।
রাজা ও সামন্তপ্রভুদের নেতৃত্বে অন্যান্য বাহিনীগুলো অগ্রসর হয় দক্ষিণ ও উত্তর ফ্রান্স (তাই তাদেরকে ফ্র্যাংক বলা হতো) এবং দক্ষিণ ইতালির দিক থেকে। তারা কন্সটান্টিনোপলে জড়ো হয়। এই বাহিনী এশিয়া মাইনর পার হলে কালিজ আরসালান তাদেরকে বাধা দেন। ফলে দুই পক্ষে ব্যাপক সংঘর্ষ বেঁধে যায়। ক্রুসেডাররা তাঁকে পরাজিত করে আট মাস অবরোধ করে রাখার পর এন্টাকিয়া (সেসময় এই শহরের নাম ছিলাে আন্তিও। কিন্তু এটার বর্তমান নাম এন্টাকিয়া যা তুরস্কের হাতায় প্রদেশে অবস্থিত) দখল করে। এরপর ৪৯২ হিজরিতে (১০৯৯ ঈসায়ী) এক মাস অবরোধ করে রাখার পর জেরুসালেম তাদের হস্তগত হয়। সেখানে তারা তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত দ্বীন এবং মানবতার সব নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সবরকম বর্বরতা প্রদর্শন করে। তারা প্রায় সত্তর হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। আল-আকসা মসজিদ ও এর সংলগ্ন রাস্তাগুলো মুসলিমদের রক্তে ভেসে গিয়েছিলো।
মুসলিমদের দুর্দশার কথা বর্ণনা করে ইবনুল আসির লিখেন:
“জনগণ রমযান মাসে আল-কাদি আবু সাইদ আল-হারওয়ি’র সাথে শাম থেকে বাগদাদে পালিয়ে যায়। তিনি ক্রুসেডারদের এমন সব ভয়ানক কর্মকাণ্ড ও অপরাধের বর্ণনা দেন যাতে কারো চোখ শুষ্ক থাকতে পারে। হৃদয় স্থির হতে পারে না। তারা জুমু’আর সালাত পড়ে মুসলিমদের হত্যা, নারী-শিশুদের উপর নির্যাতন ও সম্পদ লুটপাটের কথা স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে দু’আ আর কান্নাকাটি করে সাহায্য চায়। এই পরিস্থিতিতেই তারা সেদিনের ইফতার করে।”
এই যুদ্ধের ফলে ক্রুসেডাররা শামে আস্তানা গেড়ে বসে। আলেক্সান্দ্রিয়া উপসাগর থেকে আশকেলন এবং ‘আকাবা উপসাগর থেকে আর-রুহা’র (বর্তমানে তুরস্কের উরুফা) [উরফা বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত, যার অফিসিয়াল নাম সালনিউরফা। প্রাচীনকালে এর নাম ছিলো এড়েসা] উত্তর দিক পর্যন্ত উপকূলগুলোতে অসংখ্য ঘাঁটি গড়ে তোলে।
ক্রুসেডারদের বিজয়ের কারণ
ক্রুসেডারদের বিজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ হলো জেরুজালেম ও এর আশপাশের এলাকার মুসলিমদের মধ্যকার হাজারো অন্তর্কলহ এবং মতপার্থক্য। জেরুজালেম হলো সেই ভূমি যেখান থেকে রাসূলুল্লাহকে স্ম মিরাজে নেওয়া হয়। এই ভূমিতে ক্রুসেডাররা নিজ যোগ্যতায় কখনো মুসলিমদের উপর চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। মুসলিম উম্মাহ’র মধ্যকার বিভিন্ন ঝগড়া-বিবাদ লক্ষ করেই তারা এই দুর্বল জায়গায় আঘাত করে। এভাবেই সুযোগ বুঝে মুসলিম বিশ্বে হামলে পড়ে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে এবং সম্মানিত এক জাতিকে লাঞ্ছিত করে ছাড়ে।
এ কারণেই প্রথম ক্রুসেড এর বর্ণনা দিতে গিয়ে ইতিহাসবিদগণ সেসময় মুসলিম সমাজের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ-
১। ক্রুসেডাররা যখন জেরুসালেম অবরোধ করে রেখেছিলো, মুহাম্মাদ ইবনু মালিকশাহ ( মুহাম্মাদ ইবনে মালিক শাহ ১০৭২-১০৯২ সাল পর্যন্ত তুর্কি সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান ছিলেন।) তাঁর সৎভাই বারকিয়ারুকের সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
২। শামের রাজারা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত থাকা অবস্থায় ফ্র্যাংকরা অ্যাকরা (এর আরবী নাম ke, ইংরেজীতে acre, ako ইত্যাদি নামে পরিচিত হলেও সাধারণত এটা akko হিসেবে উচ্চারিত হয়। বর্তমান এটি ইসরায়েলে অবস্থিত।) অঞ্চল দখল করে নেয়।
৩। মুসলিম দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতো। কিছু মুসলিম দেশ অপর মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে ফ্র্যাংকদের সাহায্য চাইতো।
ইবনুল আসির সহ অনেক ইতিহাসবিদই এই কারণগুলো আলোচনা। করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় মুসলিম উম্মাহ নিজেই নিজের পরাজয়ের জন্য দায়ী ছিলো। আল্লাহ তাদের উপর কোনো যুলুম করেননি, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করেছে।
দ্বিতীয় ক্রুসেড – হাতিনে বিজয়ের পূর্বাভাস
আগেই বলা হয়েছে যে মুসলিম ঐক্যের অবক্ষয়ই ছিলো ক্রুসেডারদের জেরুজালেম দখলে সাফল্যের প্রধান কারণ। একটি বিপ্লবী ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে ক্রুসেডারদেরকে পরাজিত করা তাই অসম্ভব হয়ে গিয়েছিলো। এই বিপ্লবের একটি আভাস পাওয়া যায় যখন ৫২১ হিজরিতে ‘ইমাদুদ্দীন যাঙ্কি মসুল থেকে মা’আররাত আন-নুমান (মা’আররাত আল নুমান সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে অবস্থিত।) পর্যন্ত বিস্তৃত একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। ইমাদুদ্দীন অসংখ্যবার ক্রুসেডারদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এর মধ্যে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিলো আর-রাহা-তে ৫৩৯ হিজরিতে সংঘটিত সংঘর্ষ। যুদ্ধে পরাজিত হলে এই অঞ্চল থেকে ক্রুসেডারদের প্রভাব দুর্বল হয়ে যায়।
এইসব পরাজয়ের কারণে ক্রুসেডাররা আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং দ্বিতীয়। ক্রুসেডের পরিকল্পনা করে। এই যুদ্ধে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চম লুই এবং জার্মান সম্রাট তৃতীয় কনরাড অংশ নেন।
তাঁরা ‘ইমাদুদ্দীন মাহমুদকে[*] হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। তিনি তাঁর পিতা ইমাদুদ্দীন যাঙ্কির মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্যের পশ্চিমাংশ শাসন করেন। তাঁকে প্রধান লক্ষ্যবস্ত বানানোর কারণ হলো তাঁকেই তারা ফ্র্যাংকদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করতো। ক্রুসেডাররা শামের দিকে অগ্রসর হয়ে অল্প সময়ের জন্য তা অবরোধ করে হাল ছেড়ে দেয়। ৫৪৩ হিজরিতে অবরোধ তুলে ফেলা হয়। এভাবেই দ্বিতীয় ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটে। ক্রুসেডারদের ব্যর্থতা মুসলিমদেরকে উজ্জীবিত করে তোলে যা পরবর্তীকালে হাত্তিনের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
[* ইমাদুদ্দীন যাঙ্কির বেশ কয়েকজন ছেলে ছিলো। তাদের মধ্যে বড় দুইজন ছিলেন সাইফুদ্দীন এবং নুরুদ্দীন মাহমুদ। এই দুই ভাই বাবার রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যকে দুই ভাগে ভাগ করেন। সাইফুদ্দীন মসুলকে রাজধানী রেখে পূর্ব দিকের অংশ শাসন করেন এবং নুরুদ্দীন আলেপ্পোকে রাজধানী করে পশ্চিম দিকের দখল নেন। নুরুদ্দীনের শাসনকৃত অংশ ছিলো ক্রুসেডারদের ভূখণ্ডের কাছাকাছি। যে কারণে ক্রুসেডারদের সাথে নুরুদ্দীনের সংঘর্ষ
হওয়াটা অনুমিতই ছিলো।]