খালিদ বিন ওয়ালিদ এর নামের ক্যালিগ্রাফিক উপস্থাপনা
হজরত আবু সুলায়মান খালিদ ইবনে আল ওয়ালিদ ইবনে আল মুঘিরাহ (রা.) ছোট-বড় প্রায় শখানেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও আজীবন অপরাজিত থাকায়
ইতিহাসবিদেরা খালিদ বিন ওয়ালিদকে সমর ইতিহাসের অন্যতম সেরা সেনাপতি বলে অনেক আগেই মেনে নিয়েছেন। তাছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট
সেনাদল নিয়েও অপ্রতিরোধ্য সব ক্যাভালরি রণকৌশলের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের বিশাল সব শত্রুবাহিনীকে বারবার পরাস্ত করে তিনি সর্বকালের সেরা ক্যাভালরি জেনারেল হিসেবেও স্বীকৃত।
বাইজান্টাইন রোমান শাসনামলে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২৯ সালে বাইজান্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি
লিখলেন। মহানবী (সা.)-র সেই দাওয়াতের চিঠি বহনকারী দূত লেভান্টের মুতা গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছালে ঘাসানিদ আরবেরা তাকে হত্যা করে।
দূত হত্যা সব সময়ই অগ্রহণযোগ্য। অতএব মহানবী (সা.) মুতাবাসী বাইজান্টাইনদের বিরদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন।
যায়িদ বিন হারিযাহর নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য নিয়ে মুসলমান বাহিনী মুতা অভিযানে রওনা দিয়েছে জেনে সম্রাট হেরাক্লিয়াস দশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মুসলমানদের বির“দ্ধে এগিয়ে এলেন।
শুরু হলো অসম এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে খালিদ যুদ্ধ করতে করতে ইতিমধ্যে নয়টি তরবারি ভেঙে ফেলে দশমটি নিয়ে লড়ছিলেন। কিন্তু সংখ্যায় বাইজান্টাইনরা অনেক
বেশি হওয়ায় মুসলমানেরা কোনোমতেই তাদের সঙ্গে আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না।
যুদ্ধ করতে করতে যায়িদ বিন হারিযাহ শহিদ হলে জাফর বিন আবু তালিব মুসলমান সেনাপতির দায়িত্ব নিলেন। যুদ্ধ করতে করতে তিনিও শহিদ হলে আব্দুলাহ বিন রাওয়াহা কমান্ড নিজের কাঁধে তুলে নেন। কিন্তু
তিনিও শাহাদতবরণ করার পর যুদ্ধরত মুসলমান যোদ্ধারা খালিদের হাতে সেনাপতিত্ব সঁপে দেন।
দায়িত্ব পাওয়ার পর খালিদ সুকৌশলে মুসলমান বাহিনীকে বাইজান্টাইনদের থাবা থেকে সরিয়ে আনেন। তিনি অত্যড় প্রজ্ঞার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করে নিশ্চিত পরাজয় থেকে মুসলমান বাহিনীকে রক্ষা করেন এবং
তাদের নিরাপদে মদিনায় ফিরিয়ে আনেন। খালিদের এই কৃতিত্বের কথা শোনার পর মহানবী (সা.) বললেন, “অবশেষে একজন ‘সাইফুল-াহ যুদ্ধের হাল ধরেছে।”
সেই থেকে খালিদের নাম হয়ে গেল ‘সাইফুল-হি আলমাসলুল।
খালিদ বিন ওয়ালিদের জন্মঃ
আবু সুলায়মান খালিদ ইবনে আল ওয়ালিদ ইবনে আল মুঘিরাহ ৫৯২ সালে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু মাখজুম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ওয়ালিদ ইবনে আল মুঘিরাহ ছিলেন বনু মাখজুম গোত্রের প্রধান। খালিদরা ছিলেন পাঁচ ভাই আর দুই বোন। জন্মের পরপরই আরব প্রথা অনুযায়ী তাকে এক বেদুইন দুধ-মায়ের কোলে তুলে দেওয়া হয়। এরপর পাঁচ কি ছয় বছর বয়সে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন।
খালিদের শৈশবঃ
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ গড়নের আর অসম্ভব ডানপিটে। ঐতিহ্যগতভাবেই কোরাইশদের সেরা যোদ্ধা আর কমান্ডাররা সবাই ছিলেন বনু মাখজুম গোত্রের। তাই ছেলেবেলা থেকেই তিনি ঘোড়ায় চড়া ও তরবারি, তির, বর্শা আর বল্লম চালানো শিখতে শুরু করেন। যদিও বল্লমই ছিল তার প্রিয় অস্ত্র; কিন্তু অন্য সব অস্ত্রেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। এ ছাড়া তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের সেরা কুস্তিগিরদের একজন এবং একবার মল্লযুদ্ধে উমর বিন খাত্তাবকে আছড়ে ফেলে তার পা ভেঙে দিয়েছিলেন।
মক্কা মদিনার কোন্দলঃ খালিদের বাবা আল ওয়ালিদ ছিলেন ইসলামের ঘোর বিরোধী। মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর থেকে মক্কাবিজয়ের আগ পর্যন্ত মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে মদিনাবাসীর যুদ্ধ লেগেই ছিল। বদরের যুদ্ধ ছিল মক্কাবাসীর সঙ্গে মদিনাবাসীর প্রথম যুদ্ধ।
কিন্তু খালিদ এই যুদ্ধের সময় তাদের ব্যবসায়িক কাফেলার সঙ্গে সিরিয়ায় ছিলেন। বদরের যুদ্ধে খালিদের ভাই ওয়ালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলমানদের হাতে বন্দি হন। যুদ্ধশেষে খালিদ তার বড় ভাই হাশাম বিন ওয়ালিদকে নিয়ে মদিনা যান মুক্তিপণ দিয়ে ওয়ালিদকে ছাড়িয়ে আনতে। চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ দিয়ে তিনি ওয়ালিদকে ছাড়িয়ে আনেন। কিন্তু ফেরার পথে ওয়ালিদ পালিয়ে মদিনায় ফিরে যান এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
খালিদের ইসলাম গ্রহণ- এরপর খালিদ উহুদ এবং খন্দকের যুদ্ধে কোরাইশদের হয়ে মুসলমানদের বির“দ্ধে লড়েন। ৬২৮ সালে হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ১০ বছরের জন্য মক্কা আর মদিনাবাসীর ভেতর শান্তি নেমে আসে। এরই মধ্যে ওয়ালিদ মদিনা থেকে চিঠির মাধ্যমে খালিদকে বারবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিতে থাকেন।
একপর্যায়ে খালিদ মদিনা গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধাড় নেন এবং তার এ সিদ্ধারে পরিপ্রেক্ষিতে তার বাল্যবন্ধু ইকিরিমাহ এবং কোরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ক্ষিপ্তভাবে তাকে বিরত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ৩১ মে ৬২৯ সালে খালিদ মদিনা গমন করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তিনি একজন যোদ্ধা হিসেবে মহানবী (সা.) র প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন।
মূর্তি ধ্বংসঃ তখন প্রায় আরবজুড়েই নানান দেবদেবীর মূর্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। আর প্রাচীন আরববাসী এসব দেবদেবীর মূর্তি পূজা করত। মক্কার কাছেই ছিল আল উজ্জার মূর্তি ও মন্দির। আল উজ্জাকে গ্রিক পৌরাণিক দেবী আফ্রোদিতি র আরব্য সংস্করণ বলা যেতে পারে। কোরাইশরা একে নিরাপত্তার দেবী হিসেবে পূজা করত। মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা.) মক্কা এবং অন্যান্য আরব এলাকা থেকে মূর্তি অপসারণ শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৬৩০ সালের রমজান মাসে তার নির্দেশে খালিদ আল উজ্জার মূর্তি ধ্বংস করতে নাখলাহ যান।
মূর্তি ধ্বংস করে ফিরে আসার পর মহানবী (সা.) জানতে চাইলেন মূর্তি ধ্বংসের সময় খালিদ অস্বাভাবিক কিছু দেখেছেন কি না।
উত্তরে খালিদ যখন ‘না’ বললেন,
তখন মহানবী (সা.) বললেন যে খালিদ যে মূর্তিটি ভেঙে এসেছে তা আল উজ্জার আসল মূর্তি না।
লজ্জিত খালিদ পুনরায় নাখলাহ গিয়ে আসল আল উজ্জার মূর্তি খুঁজে বের করেন।
ইথিওপিয়ান নগ্ন সেবাদাসীর ফাদঃ- খালিদের আসার সংবাদ পেয়ে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত আল উজ্জার মূর্তির গলায় একটি তরবারি ঝুলিয়ে দিয়ে পালিয়ে যান। খালিদ আল উজ্জার মূর্তি ভাঙা শুর করতে যেতেই নগ্ন এক সেবাদাসী অপ্রকৃতিস্থের মতো খালিদের পথরোধ করে দাঁড়ায় এবং ইথিওপিয়ান সেই সুন্দরী তাকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু খালিদ নির্দ্বিধায় এক কোপে সেই নারীকে হত্যা করে আল উজ্জার মূর্তি ধ্বংস করে ফিরে আসেন।
খালিদ কর্তৃক বনু জাধিমাহ গোত্রে ইসলামের দাওয়াত। এরপর খালিদ যান বনু জাধিমাহ গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে। কিন্তু তারা ইসলাম কবুল করতে সম্মত না হওয়ায় তিনি তাদের বন্দি করে নির্যাতন করতে শুরু করেন। ঘটনা শুনে মহানবী (সা.) খালিদের উপর অত্যন্ড্রু রুষ্ট হন এবং খালিদকে ভর্ৎসনা করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করেন।
যুদ্ধে গমন পরে খালিদ বাইজান্টাইনদের বির“দ্ধে মুতার যুদ্ধে গমন করেন এবং যুদ্ধের মধ্যেই সেনাপতিত্ব পেয়ে সফলভাবে অভিযান পরিচালনার জন্য মহানবী (সা.)-র কাছ থেকে ‘সাইফুল-াহ’’ উপাধি লাভ করেন। পরের বছর ৬৩০ সালে কুরাইশদের বিরদ্ধে মক্কাবিজয় অভিযানে খালিদ চার মুসলমান বাহিনীর একটির সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
সে বছরেই তিনি বেদুইনদের বির“দ্ধে হুনাইনের যুদ্ধে এবং তাইফ অবরোধ অভিযানে অংশ নেন। এরপর তিনি বাইজান্টাইনদের আগ্রাসন ঠেকাতে মহানবী (সা.)-র নেতৃত্বে তাবুক অভিযানে অংশ নেন। কিন্তু মুসলমান বাহিনী তাবুক পৌঁছানোর আগেই বাইজান্টাইনরা তাবুক ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ায় মহানবী (সা.) খালিদকে চার শত সৈন্যসহ দুমা অভিযানে পাঠান।
দুমাতুল জান্দালের রাজকুমার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তার ইহুদি আর খ্রিষ্টান প্রজাদের নিয়ে ইসলামের দাওয়াত কবুল করেছিলেন। ৬৩১ সালের এপ্রিল মাসে খালিদ দুমাতুল জান্দালে পুনরায় অভিযান চালান এবং এবার সর্পদেবতা ওয়াদের মূর্তি ধ্বংস করেন।
এরপর ৬৩১ সালে তিনি মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজে যোগ দেন এবং কথিত আছে যে হজের সময় তিনি মহানবী (সা.)-র কিছু চুল সংগ্রহ করেছিলেন; যা তাকে যুদ্ধে অপরাজেয় করেছিল। কথিত আছে যে খালিদ মহানবী (সা.)-র সেই চুল একটি লাল টুপিতে সেলাই করিয়ে নিয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময় ওই টুপি মাথায় দিয়ে যুদ্ধ করতেন।
রিদ্দাহ যুদ্ধ ও খালিদ বিন ওয়ালিদ
৬৩২ সালে মহানবী (সা.)-র মৃত্যুর পর অনেক শক্তিশালী আরব গোত্র মুসলমান খেলাফত শাসনের বির“দ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে শুর“ করে। ফলে শুর“ হয় রিদ্দাহ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে খলিফা আবু বকর খালিদকে সেনাপতি নিয়োগ করলে তিনি মধ্য-আরবে অভিযান পরিচালনা শুরু করেন। বুজাখা আর ঘামরার যুদ্ধে তিনি স্বঘোষিত নবী তুলেইহার বাহিনীকে পরাস্ভ করেন।
পরে তুলেইহা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আবু বকরের কাছে ক্ষমাভিক্ষা চাইলে আবু বকর তাকে ক্ষমা করে দেন। আরও পরে সাসানিদদের বির“দ্ধে বিখ্যাত নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে তুলেইহা শাহাদতবরণ করেন।
এরপর খালিদ নাক্রা এবং জাফারের যুদ্ধে বনু সালিম গোত্রের নেত্রী সালমার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত্র করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সালমাকে হত্যা করেন। এ যুদ্ধের পর মদিনার আশপাশের অন্যান্য গোত্র খেলাফতের বশ্যতা স্বীকার করে নিলেও মালিক বিন আবু নুয়ারাহ-এর বনু ইয়ারবু গোত্র মুসলমান হয়েও খেলাফতকে অস্বীকার করল।
মালিক সরাসরি খালিদের সঙ্গে কোনো যুদ্ধে না জড়িয়ে আরেক স্বঘোষিত নবী সাজ্জাহর সঙ্গে হাত মেলান। কিন্তু খালিদ দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হন। খালিদ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মালিককে হত্যা করেন এবং তার স্ত্রী লায়লাকে বিয়ে করেন।
উমর বিন খাত্তাব খালিদের এমন আচরণের ঘোর বিরোধিতা করেন এবং অনেকেই মনে করেন খালিদ-উমরের মনোমালিন্যের অনেক কারণের ভেতর এ ঘটনাটি অন্যতম। পরে ৬৩২ সালের ডিসেম্বরে ইয়ামামার যুদ্ধে আরেক স্বঘোষিত নবী মুসাইলিমাহর বাহিনীকে পরাস্ত্র করার মধ্য দিয়ে রিদ্দাহ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়।
খালিদ বিন ওয়ালিদ এর পার্সিয়ান অভিযান
রিদ্দাহ যুদ্ধের পর খলিফা আবু বকর খেলাফতকে সুসংহত আর সম্প্রসারিত করতে বাইজান্টাইন আর পার্সিয়ানদের বির“দ্ধে অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধাড় নেন। ফলে আঠার হাজার সৈন্য নিয়ে খালিদ পার্সিয়ান অভিযান শুরু করেন। সেখানে তিনি সালাসিল, ইউফ্রেতিস, ওয়ালাজা আর উল্লাইসের যুদ্ধে জয়ী হয়ে ৬৩৩ সালের মে মাসের ভেতর পার্সিয়ানদের হাত থেকে লোয়ার মেসোপটেমিয়া দখল করে নেন। এরপর তিনি আনবার শহর অবরোধ করেন এবং জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ নাগাদ আইন আল তামর পর্যন্ত দখল করে নেন।
এ পর্যায়ে দুমাতুল জান্দালে বিদ্রোহীরা আয়াজ বিন ঘানামের ছোট্ট মুসলমান বাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে জেনে দুমাতুল জান্দালে ছুটে গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। সেখান থেকে তিনি পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন এবং ফেরার পথে বিশাল এক পার্সিয়ান বাহিনী জড়ো হওয়ার সংবাদ পেলেন। বিশাল এই সেনাবাহিনী চারটি গ্যারিসনে (সেনাছাউনি, সেনানিবাস অথবা দুর্গ) জড়ো হয়েছিল। খালিদ মুজাইয়াহ, সানিঈ ও জুমাইলের পৃথক যুদ্ধে এই বাহিনীকে একে একে পর্যুদস্ত করেন।
পার্সিয়ান রাজধানী দখল পরিকল্পনা৷ এবার খালিদ পার্সিয়ান রাজধানী দখলের পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু পার্সিয়ান রাজধানী দখলের আগে ফিরাজ আর কাদেশিয়াহর গ্যারিসন দখল করা জরুরি। অতএব ৬৩৩ সালের ডিসেম্বরে ফিরাজের যুদ্ধে তিনি ফিরাজ শহর দখল করে এবার কাদেশিয়াহর পথে রওনা দেন। পথিমধ্যেই তিনি বাইজান্টাইনদের বির“দ্ধে সিরিয়ান রণাঙ্গনের কমান্ডার হিসেবে যোগদানের নির্দেশ পান এবং পার্সিয়ান রণাঙ্গন ত্যাগ করে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
সিরিয়ান রণাঙ্গন ও আজনাদাইন যুদ্ধ ৬৩৪ সালের জুন নাগাদ খালিদ সিরিয়ান রণাঙ্গনে যোগ দেন। পথে কারাতাইন আর হাওয়ারিনের যুদ্ধে দুটো বাইজান্টাইন মরুদুর্গ দখল করেন। এরপর তিনি বসরার দিকে এগোতে থাকেন, যেখানে আবু উবায়দার মুসলমান বাহিনী বসরা অবরোধ করে আছেন। ৬৩৪ সালের মধ্য জুলাইয়ে বসরার পতনের মধ্য দিয়ে ঘাসানিদ বংশের পতন ঘটে। ৩০ জুলাই খালিদ আজনাদাইনের যুদ্ধে বাইজান্টাইনদের পরাজিত করেন এবং লেভান্টজুড়ে বাইজান্টাইন আধিপত্যকে শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
দামেস্ক অভিযান এবার খালিদ দামেস্ক দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে দামেস্কের গভর্নর থমাস তাকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন। থমাসের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে ৬৩৪ সালের ২০ আগস্ট খালিদের মুসলমান বাহিনী দামেস্ক অবরোধ করে এবং ৩০ দিনের মাথায় দামেস্ক দখল করে নেয়।
সিরিয়ার রণাঙ্গন থেকে অপসারণ দামেস্ক অবরোধ চলাকালেই খলিফা আবু বকর মারা যান এবং উমর বিন খাত্তাব খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেন। খলিফা হয়েই উমর খালিদকে সিরিয়ার রণাঙ্গন থেকে অপসারণ করে আবু উবায়দাকে সেনাপতি মনোনীত করেন। আবু উবায় উত্তর সিরিয়া থেকে মধ্য-সিরিয়া মুসলমানদের দখলে আসার পর উত্তর সিরিয়ার সঙ্গে প্যালেস্টাইনের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। আবু উবায়দা তার সেনাবাহিনীকে চার ভাগে ভাগ করে চারদিকে অভিযান চালাতে শুর“ করলেন।
হেরাক্লিয়াস এর বাইজান্টাইন বাহিনী
মুসলমানদের এমন অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকলে দ্রুতই একসময় তারা গোটা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়া জেনে সম্রাট হেরাক্লিয়াস বিশাল বাইজান্টাইন বাহিনী জড়ো করে মুসলমান সেনাবাহিনীকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলেন।
ইয়ারমুক যুদ্ধ‘র ক্যাভালরি কমান্ডার ও উপদেষ্টা খালিদ
আবু উবায়দা খালিদকে তার ক্যাভালরি কমান্ডার এবং প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিলেন। খালিদের পরামর্শে ৬৩৬ সালের ২০ আগস্ট ইয়ারমুক প্রান্তরে মুসলমান বাহিনী বাইজান্টাইন বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে।
জেরুজালেমে অবরোধ৷ ইয়ারমুখে বাইজান্টাইনদের পরাস্ত্র করার পর মুসলমান বাহিনী লেভান্টে বাইজান্টাইনদের শেষ শক্ত ঘাঁটি জেরুজালেম অবরোধ করে। দীর্ঘ চার মাস অবরোধের পর ৬৩৭ সালের এপ্রিলে খলিফা উমরের উপস্থিতিতে জেরুজালেম আত্মসমর্পণ করে। জেরুজালেম পতনের পর আবু উবায়দা আর খালিদ উত্তর সিরিয়া অভিযানে নামলেন। পথে হাজিরের যুদ্ধে বাইজান্টাইনদের পরাড় করে ৬৩৭ সালের অক্টোবরের ভেতর আলেপ্পো পর্যন্ত দখলে নিয়ে নেন।
আয়রন ব্রিজের যুদ্ধ ও এন্টিওখ দখল
এরপর আয়রন ব্রিজের যুদ্ধে বাইজান্টাইনদের ফের পরাজিত করে তারা বাইজান্টাইন রাজধানী এন্টিওখ অবরোধ করেন এবং ৩০ অক্টোবর এন্টিওখের পতন হয়।
এরপর খালিদ আরও উত্তরে এগোতে থাকেন। তিনি সফল অভিযানের মাধ্যমে জাজিরা, এডেসা, আমিদা, মালাটিয়া, আর্মেনিয়া আর মধ্য আনাতলিয়া পর্যন্ত দখল করে নেন।
এমতাবস্থায় খলিফা উমর মুসলমান বাহিনীদের অগ্রাভিযান বন্ধ করে ইতিমধ্যে দখল করা এলাকায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা জোরদারে মনোযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। ফলে আনাতলিয়া আর আর্মেনিয়া অভিযানের মাধ্যমে খালিদের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে ।
এলকোহলে গোসলের দায়ে খলিফা উমরের নিকট লিখিত জবাবদিহি।
এমেসা থাকাকালে একবার খালিদ এক বিশেষ পানীয় দ্বারা গোসল করেন যাতে অ্যালকোহল মেশানো ছিল। গুপ্তচরের মাধ্যমে খলিফা উমর বিষয়টি জানতে পারেন এবং খালিদের কাছে এ ঘটনার লিখিত ব্যাখ্যা চান। ইসলামে অ্যালকোহল পানে নিষেধাজ্ঞা আছে কিন্তু গোসলের ব্যাপারে কিছু বলা নেই মর্মে ব্যাখ্যা দেন খালিদ; এবং খলিফা উমর তা মেনে নেন।
অপব্যয়িতার জন্য সেনাবাহিনী হতে বরখাস্ত
আবার ৬৩৮ সালে মারাস দখলের পর বিখ্যাত কবি আসওয়াস খালিদের গুণকীর্তন করে এক কবিতা লিখে খালিদের মন জয় করে নেন। খুশি হয়ে খালিদ তাকে ১০ হাজার দিরহাম উপহার দেন।
খলিফা উমর এ ঘটনা জানতে পেরে আবু উবায়দাকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কারণ খালিদ যদি সরকারি কোষাগার থেকে এই অর্থ দিয়ে থাকেন, তবে তা ছিল খেয়ানত। আর যদি নিজ সম্পদ থেকে তা দিয়ে থাকেন তা হলে তিনি অপব্যয়ী। কিন্তু আবু উবায়দা নিজেই খালিদের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। তাই তিনি এই অপ্রিয় কাজটি করতে অপারগতা প্রকাশ করলে অবশেষে বিলাল ইবনে রিবাহ খালিদকে এমেসা ডেকে পাঠান এবং ঐ অর্থের উৎস জানতে চান। খালিদ ঐ অর্থ তার নিজের বলে দাবি করলে অমিতব্যয়িতার অভিযোগে খলিফা উমরের নির্দেশে তাকে মুসলমান সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করেন।
মদিনা গমন
বরখাস্ত হওয়ার পর খালিদ তার মোবাইল গার্ডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মদিনা ফিরে যান এবং খলিফা উমরের দরবারে হাজির হয়ে খলিফা উমরের এমন সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চান। খালিদের বির“দ্ধে খলিফা উমর তার অবস্থান এভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে মুসলমানেরা ভাবতে শুরু করেছে যে খালিদকে ছাড়া মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা অসম্ভব, যা অগ্রহণযোগ্য।
খালিদ বিন ওয়ালিদ এর অবসর জীবনযাপন
খালিদ খলিফা উমরের এই আশঙ্কাকে মেনে নিলেন এবং এমেসা ফিরে গিয়ে অবসর জীবনযাপন শুরু করলেন। ৬৪২ সালের হজ শেষে খলিফা উমর অসমাপ্ত পার্সিয়ান অভিযান পুনরায় শুরু করার পরিকল্পনা করেন এবং খালিদকে সে-অভিযানের সেনাপতি হিসেবে পুনর্নিয়োগের কথা চিন্তা করেন। কিন্তু মদিনা পৌঁছাতেই তিনি জানতে পারলেন যে খালিদ বিন ওয়ালিদ আর নেই।
মহানয়কের পরলোকগমন।
খালিদ যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদতবরণের জন্য উদগ্রীব ছিলেন। তিনি বলতেন, “আমি এত উদ্গ্রীব হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদতবরণ করতে চেয়েছি যে আমার শরীরে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে কোনো আঁচড় বা ক্ষতের দাগ নেই। অথচ আজ আমি একটা বৃদ্ধ উটের মতো বিছানায় শুয়ে মরতে বসেছি।” উত্তরে খালিদের স্ত্রী বলতেন, “আপনি আল্লাহর তরবারি, আর আল্লাহর তরবারি কি কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে ভাঙতে পারে? আপনার নিয়তি শহিদ হওয়ার নয়, আপনার নিয়তি অপরাজেয় হয়ে মরবার।”
খলিফা উমর কারো মৃত্যুর পর সেই মৃতের জন্য বিলাপ করা পছন্দ করতেন না এবং এ ব্যাপারে তিনি কড়া নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিলেন। কিন্তু খালিদের মৃত্যুর পর বনু মখজুমের নারীরা যখন মাটিতে গড়াগড়ি করে বুক চাপড়ে বিলাপ করছিলেন, তখন উমর তাদের বাধা দিতে মানা করলেন। কারণ তিনি নিজেও জানতেন যে মানবসভ্যতার ইতিহাসে দ্বিতীয় কোনো খালিদ হয়তো আর কখনোই জন্মাবে না, তাই তাদের এই বিলাপ আর আহাজারি অনর্থক নয়।