ভূমিকা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচির ভূমিকা অনন্য ও অসাধারণ। এই কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করে। ৬ দফা ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ছয় দফাতে পাকিস্তানকে ভাঙতে চাওয়া হয়নি, চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে।
ছয় দফা : তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিম্নলিখিত দাবিগুলো উত্থাপন করেন।
(১ম দফা)
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি :
পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। এর ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এ উভয় অঞ্চলকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির। প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আইনসভা হবে সার্বভৌম।
(২য় দফা)
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা :
যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয় অঙ্গরাজ্যসমূহের হাতে থাকবে।
(৩য় দফা)
মুদ্রা ও অর্থ ব্যবস্থা :
এ দফায় দেশের মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
১.স্বতন্ত্র মুদ্রা ব্যবস্থা :
দেশের দু অঞ্চলের জন্য সহজে বিনিময় যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রার লেনদেন হিসাব রাখার জন্য দু অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে এবং মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে।
২.একই মুদ্রা ব্যবস্থা :
দু অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। তবে শাসনতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে এক অঞ্চল থেকে মুদ্রা ও মূলধন অন্য অঞ্চলে পাচার হতে না পারে। এ ব্যবস্থায় পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুঅঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
(৪র্থ দফা)
রাজস্ব, কর, ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা :
সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ সংগে সংগে ফেডারেল তহবিলে জমা হবে। শাসনতন্ত্রে এ ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের বিধান থাকবে।
(৫ম দফা)
বৈদেশিক মুদ্রা ও বাণিজ্য :
বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর হাতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতা থাকবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্যের ব্যাপারে প্রদেশগুলো যুক্তিযুক্ত হাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মিটাবে।
৬ষ্ঠ দফা :
প্রতিরক্ষা আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রদেশগুলোকে নিজস্ব কর্তৃত্বের অধীনে আধা সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও পরিচালনা করার ক্ষমতা দেওয়া হবে ১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা কর্মসূচি অনুমোদন করা হয়।
ছয় দফা আন্দোলনের গুরুত্ব/তাৎপর্য :
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবি পরবর্তীতে ছয় দফা আন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলনের গুরুত্ব/তাৎপর্য নিম্নে আলোচনা করা হলো :
স্বাধিকার আন্দোলন :
ছয় দফা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন। এ আন্দোলনের উপর ভিত্তি করেই জনগণ স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বাঙালির স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ তৎকালীন :
সরকারের নিষেধাজ্ঞা ও ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বাংলার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছয় দফার সপক্ষে মিছিল, সভা ও শোভাযাত্রা করে। ইতিপূর্বে এদেশের কোনো আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত লোক অংশগ্রহণ করেনি এবং এত প্রাণহানিও ঘটেনি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় হয় :
ছয় দফা আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় হয় এবং ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্য আরও জোরদার হয়। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে ছয় দফা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
স্বৈরাচারী শাসকের পতন :
ছয় দফা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের দাবি। স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এ কর্মসূচি নিরাশার আঁধারে নিক্ষিপ্ত বাঙালি জাতিকে যুগিয়েছে শক্তি, যুগিয়েছে প্রেরণা।
বাঙালির মুক্তিসনদ:
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নির্যাতন ও অবিচারের বিরুদ্ধে ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তিসনদ। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন যে, ছয় দফা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা গোটা বাঙালির মুক্তিসনদ এবং বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত পদক্ষেপ। অতএব, বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে :
ছয় দফা কর্মসূচি | ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের এ কর্মসূচির উপর ভিত্তি করেই ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে।.
সত্তর-এর নির্বাচনে জয়লাভ :
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন ছয় দফা কর্মসূচিকে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনি মেনিফেস্টো হিসেবে দাঁড় করায়। আর এ ছয় দফার ভিত্তিতেই গণরায় লাভ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
পরিশেষে:
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ম্যাগনাকার্টা যেমন উজ্জ্বল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ছয় দফা তেমনই উজ্জ্বল। ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়েই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল।