রাজনৈতিক তত্ত্ব কী? অথবা, রাজনৈতিক তত্ত্ব বলতে কী বুঝ?
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সর্বদাই নিজেদের ভাবধারাকে একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের জন্য তত্ত্ব গঠন অপরিহার্য কারণ সকল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই হলো তত্ত্বগত। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনৈতিক তত্ত্বের উপরই মূলত একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
রাজনৈতিক তত্ত্বের সংজ্ঞা
অতীতে রাজনৈতিক তত্ত্ব বলতে প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশো, মিল প্রমুখ চিন্তাবিদদের জাঁকজমকপূর্ণ দার্শনিকদের লালিত তত্ত্বকেই বোঝায়। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক তত্ত্বের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে। মূলত রাজনৈতিক তত্ত্বের সংজ্ঞায় আমরা বলতে পারি যে, রাজনীতি সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব যেকোনো রাজনৈতিক ঘটনা গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে তাকে রাজনৈতিক তত্ত্ব বলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ নিম্নে রাজনৈতিক তত্ত্বের কয়েকটি প্রামাণ্য
সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
ফ্রান্সিক কোকার (Francis Coker)-এর মতে, “যখন সরকার তার সংগঠন এবং কার্যকে সাময়িক ফলাফল অর্জনের নিমিত্ত কেবলমাত্র বর্ণনা, ভুলনা ও বিচারের তথ্যরূপে গ্রহণ না করে মানুষের নিরন্তন প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা ও মতামতের মূল্যায়নের তথ্য হিসেবে পরিগণিত হয়, তখন রাজনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে।
কার্ল জি. হেলে (Carl J. Hempel) বলেন, “রাজনৈতিক তত্ত্ব বিভিন্ন বিষয়ে এক নিয়মিত বা সমরূপ নমুনা সম্পর্কে ধারণা দান করে।
জে. এ. বিল এবং আর. এল. হার্ডসেড (J.A. Bill and R.L.. Hardgrave) বলেছেন, “Theory is a set of systematically related generalizations suggesting new observations for empirical testing.” সাধারণ তত্ত্ব বলতে বোঝায় বাস্ত বক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য পর্যবেক্ষণমূলক এক সাধারণ সূত্রে যা অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরস্পরের সাথে সংশ্লিষ্ট।
পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক তত্ত্বকে প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। জে. রোলাল্ড পেনক রাজনৈতিক তত্ত্বকে পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথা : নৈতিক, কাল্পনিক, সমাজতান্ত্রিক, আইনগত এবং রাজনৈতিক। কালের বিবর্তনধারায় রাজনৈতিক তত্ত্ব একটি শক্ত কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যায় ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
রাজনৈতিক তত্ত্বের বিষয়বস্তু
ভূমিকা : রাজনৈতিক তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি আলোচ্য বিষয়) গ্রাজনৈতিক তত্ত্ব রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের এক বিশেষ ধরনের চিন্তাভাবনা) রাজনীতি প্রধান আলোচ্য বিষয়সমূহ রাজনৈতিক তত্ত্বের অংশ। রাজনৈতিক তত্ত্ব কতকগুলো রাজনৈতিক বিষয়কে একত্রিত করে থাকে? রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর গুরুত্ব সাধারণত রাজনৈতিক তত্ত্বেরই অন্তর্ভুক্ত।
→ রাজনৈতিক তত্ত্বের বিষয়বস্তু বিষয়বস্তুসমূহ আলোচনা করা হলো
রাজনৈতিক তত্ত্বের ব্যবহারিক দিক:
বাস্তব জীবনের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও কাঠামো গড়ে তোলার চিন্তাভাবনাকে রাজনৈতিক ব্যবহারিক তত্ত্ব বলা হয়। যেমন- বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ন ও রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তাভাবনা) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিভিন্ন রাজত্ব ও শাসনব্যবস্থার অন্তর্গত এ ধরনের ব্যবহারিক চিন্তা- ভাবনার উদাহরণ পাওয়া যায়) ব্রোষ্ট্রের শক্তি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠার মাধ্যমে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ পায়। ব্যবহারিক চিন্তাভাবনা রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার একটি দিকমাত্র।
রাজনৈতিক তত্ত্বের তাত্ত্বিক দিক :
রাজনৈতিক তত্ত্বের বিষয়বস্তু তত্ত্বগত দিক থেকে ব্যবহারক দিক থেকে অনেক আলাদা। রাজনৈতিক তত্ত্বের বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো তত্ত্বগত দিক। এটিকে অনেক সময় কেতাবি বা গ্রন্থগত রাষ্ট্রতত্ত্ব বলা হয়।(রাজনৈতিক তত্ত্বের রাজনৈতিক দিক বলতে এই কেতাবী রাষ্ট্রচিন্তাকে বোঝায়। এরা রাজনৈতিক কাঠামোর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে থাকে।)
রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা
রাজনৈতিক তত্ত্বের অন্যতম আরেকটি বিষয়বস্তু হলো রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা। এক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের উৎপত্তি, গঠন, পরিবর্তন, কার্যাবলি, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য, সার্বভৌমত্ব প্রভৃতি তত্ত্বগত আলোচনার মধ্যে অন্তর্গত থাকে। অর্থাৎ বলা যায়, রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনা ও ভাবভিত্তিক।
রাজনৈতিক মূল্যবোধের আলোচনা
রাজনৈতিক মূল্যবোধ একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো রাষ্ট্রে বসবাসরত জনগণ যেসব রাজনৈতিক আইনকানুন, আচার-আচরণ মেনে চলে তাকে রাজনৈতিক মূল্যবোধ বলা হয়। রাজনৈতিক মূল্যবোধের সাথে সরকার ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক মূল্যবোধের ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। রাজনৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতিতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান জীবনধারা অভিজ্ঞতার ধারা মানুষের রাষ্ট্রসম্পর্কিত চিন্তাভাবনা প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক তত্ত্বের মাধ্যমে মানুষ তার অভিজ্ঞতাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে। তাই অধিকাংশ রাজনৈতিক তত্ত্বই হয় মানুষের কোনো কর্তৃত্ব মেনে চলা বা পরিবর্তনের আশায় উচ্চ কর্তৃত্বের সমালোচনা সম্পর্কিত।