Monday, 23-December, 2024
Homeবিশ্ব ও ইতিহাসইতিহাসসেলজুক সুলতান মালিক শাহ'র পরিচয় ও তার কৃতিত্ব।

সেলজুক সুলতান মালিক শাহ’র পরিচয় ও তার কৃতিত্ব।

সুলতান মালিক শাহের পরিচয় ও কৃতিত্ব (Introduction and Achievements of Seljuq Sultan Malik Shah)

সুলতান মালিক শাহ’র পরিচয়

সেলজুক বংশের সুলতানদের মধ্যে মালিক শাহ (শাসনকাল: ১০৭২-১০৯২ খ্রি.) সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ও সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। পিতা আল্প আরসালানের মৃত্যুর পর আবুল ফাতাহ মালিক শাহ সেলজুক শাসক হন। আড়ম্বর, ঐশ্বর্য ও জনকল্যাণের দিক দিয়ে মালিক শাহের শাসনকাল রোমান অথবা আরব শাসনের শ্রেষ্ঠ যুগের সমকক্ষ ছিল। মালিক শাহের এ শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে যে সব বিষয় ক্রিয়াশিল ছিল বলে বিবেচনা করা হয় সেগুলো হলো—
প্রথমত, মালিক শাহের শাসনকালে সেলজুবাদের প্রভুত্ব সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে বিস্তার লাভ করে।
দ্বিতীয়ত, তিনি আব্বাসি খিলাফতকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রাজধানীকে ইস্পাহান থেকে বাগদাদে স্থানান্তরিত করেন।
তৃতীয়ত, তিনি শাসনসংস্কার ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে ইসলামি বিশ্বের গৌরবের পতাকা সমুন্নত রাখেন।

মৃত্যু, মালিক শাহ ২১ বছর রাজত্বের পর ১০৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। পি. কে. হিট্টি বলেন, “মালিক শাহের রাজত্বকালে সেলজুক ক্ষমতা সর্বোচ্চ বিন্দুতে উপনীত হয়।

সুলতান মালিক শাহ’র কৃতিত্ব

বিদ্রোহ দমন:

মালিক শাহের রাজত্বের প্রথমভাগে কয়েকটি বিদ্রোহ দেখা দেয়। তিনি এ সব বিদ্রোহ সাফল্যের সাথে দমন করেন। বিদ্রোহ গুলোর একটি পারস্যের (বর্তমান ইরান) তুসে তার ভাইয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল।

বাইজান্টাইনদের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার:

সুলতান মালিক শাহ রোমের সামন্ত রাজা সুলাইমানকে পরাজিত করে সীমান্ত পর্যন্ত সেলজুক রাজ্য বিস্তার করেন এবং অনেকগুলো দ্বীপ দখল করেন। কনস্টান্টাইন ডুকাসের পুত্রের সিংহাসন ত্যাগের পর নাইসিফোরাস বোটানিয়েটস বাইজান্টাইন সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ও তার উত্তরাধিকারী অলেক্সিয়াস কমনিসাস মালিক শাহকে ঊর্ধ্বতন প্রভু বলে স্বীকার করে তাকে করদানে সম্মত হন। ১০৭৪-৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সুলাইমান গ্রিকদের এন্টিয়ক থেকে বিতাড়িত করে সুলতানের নামে নগরটি পুনরাধিকার করেন।

রাজ্যের সংহতি বিধান:

সুলতান মালিক শাহ রাজ্য সম্প্রসারণ অপেক্ষা রাজ্যের সংহতি বিধানে বেশি মনোযোগী ছিলেন। চীনের সীমান্ত থেকে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এবং উত্তরে জর্জিয়া থেকে দক্ষিণে ইয়েমেন বিস্তৃত মালিক শাহের বিশাল রাজ্যের সর্বত্র সুখ ও শান্তি বিরাজ করত।

সাহিত্য ও ললিতকলার পৃষ্ঠপোষকতা:

মালিক শাহের উদার পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সাহিত্য ও ললিতকলা সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। তার সময়ে ইসলামি রাজ্যে ফারসি ভাষা চর্চার অভূতপূর্ব তৎপরতা দেখা যায়। মালিক শাহ সেলজুক সাম্রাজ্যের নগরগুলোতে অনেক উচ্চবিদ্যালয় নির্মাণ করেন। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “মালিক শাহের রাজত্বকালে উদার-পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সাহিত্য ও ললিতকলা সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। (৪৬)

জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ:

মালিক শাহ ছিলেন একজন প্রজারঞ্জক শাসক। আব্বাসি খলিফা রশীদ ও মামুনের মতো তিনি সওদাগর ও মুসাফিরদের নিরাপত্তার জন্য বাণিজ্য ও হজযাত্রার পথের পাশে বিশ্রামাগার ও প্রহরীগৃহ নির্মাণ করেন। তিনি রাজ্যের সর্বত্র রাস্তাঘাট, মসজিদ, মাদ্রাসা, সুরম্য অট্টালিকা ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানে স্থানে পানি নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা খনন করেন। মালিক শাহ উজির নিজাম-উল-মূলকের সহায়তায় সুষ্ঠু কর ব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য সামন্ততন্ত্র চালু করেন। তিনি সৈন্যদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করে তাদের কাছ থেকে নিয়মিত কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন।

স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা:

স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে বিচার করলে মালিক শাহের রাজত্বকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজাম-উল-মূলক প্রথম ইস্পাহানের জামে মসজিদ নির্মাণে সেলজুক স্থাপত্যরীতি প্রবর্তন করেন। সেলজুক আমলে ইরানে নির্মিত অসংখ্য মসজিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ইস্পাহানের জামে মসজিদ।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা:

মালিক শাহের অর্থানুকূল্যে বিদ্যোৎসাহী উজির নিজাম শিক্ষার প্রসারে বাগদাদে ১০৬৫ ১০৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নামে খ্যাত নিজামিয়া মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। এটি ছাড়াও তিনি রাজ্যের সর্বত্র অসংখ্য মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। ইসলামের শ্রেষ্ঠ ধর্মতাত্ত্বিক এবং চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রি.) এ মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করেন। মহাকবি শেখ সাদী এ মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা:

মালিক শাহ জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দে উজির নিজামের পরামর্শে মালিক শাহ নিশাপুরে একটি জ্যোতির্বিদ সম্মেলন আহ্বান করেন। ঐ সম্মেলনে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণীত হয়। গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য নিশাপুরে একটি মানমন্দিরও নির্মাণ করা হয়। প্রখ্যাত দার্শনিক, কবি, জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিশারদ উমর খৈয়ামের নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদসহ বিজ্ঞানীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

জালালি পঞ্জিকা প্রবর্তন:

উমর খৈয়ামের নেতৃত্বে নিশাপুরের জ্যোতির্বিদরা চান্দ্র মাসের পরিবর্তে সৌর মাস অনুযায়ী গণনার প্রথা চালু করেন। প্রচলিত গণনাপদ্ধতির যাবতীয় ভুল সংশোধন করে একটি নতুন পঞ্জিকা তৈরি করা হয়। সুলতান মালিক শাহ জালাল-উদ-দৌলাহর নামানুসারে এটির নামকরণ হয় জালালি পঞ্জিকা। ঐতিহাসিক গিবনের মতে, ‘নির্ভুলতায় এ গণনা জুলীয় গণনাকে অতিক্রম করে গ্রেগরীয় গণনার কাছাকাছি পৌঁছেছিল।’

নিজামুল মুলক ও তার অবদান:

সেলজুক রাজত্বে শাসনকাজের সংস্কার, সমৃদ্ধি এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য মালিক শাহের সুযোগ্য প্রজ্ঞাবান উজির খাজা হাসান নিজাম-উল-মুলকের অবদান ছিল অপরিসীম। আল্‌প-আরসালান এবং মালিক শাহের উজির হিসেবে খাজা হাসান সেলজুক বংশ তথা আব্বাসি সুন্নি খিলাফতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ইবনে খাল্লিকান বলেন, “মালিক শাহের প্রায় বিশ বছরের রাজত্বকালে (১০৭৩-১০৯২) নিজামুল মুলক নিজ হাতে সমস্ত ক্ষমতা এমনভাবে কেন্দ্রীভূত করেন যে, সুলতানের সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকা অথবা মৃগয়ায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না।(৪৭) নিজামের একনিষ্ঠ সেবা ও আনুগত্যে প্রীত হয়ে সুলতান মালিক শাহ তাকে ‘আতাবেগ’ (আমিরের শাসনকর্তা) উপাধিতে ভূষিত করেন। এজন্যই পি. কে. হিট্টি নিজামুল মুলককে ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসের অলঙ্কার বলে অভিহিত করেন। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “এশিয়া যে সকল উজির ও শাসকের জন্মদান করেছিল তার মধ্যে ইয়াহহিয়া বার্মাকির পর নিজাম-উল-মুলক-ই শ্রেষ্ঠ।” নিজাম-উল-মুলকের ‘সিয়াসত নামা’ গ্রন্থকে (Siyasat Namah) রাজ্য শাসনপ্রণালির ওপর লিখিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক রচনা বলে মনে করা হয়।

(৪৫) It was Malik Shah (1072-92) under whom Seljuq power reached its meridian. Ref: P.K. Hitti, History of the Arabs, p.476
(৪৬) During Malik Shah reign Arts and literature were fostered by a lavish patronage. -Ref: Syed Ameer Ali, A Short History of the Saracens, p.316
(৪৭) One of the ornaments of political history of Islam. -Ref: P.K. Hitti, History of the Arabs, p.477,
(৪৮) Nizam ul-Mulk was probably, after Yahya Barmeki, the ablest minister and administrator Asia has ever produced. -Ref: Syed Ameer Ali, A Short History of the Saracens, p.315

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Roma Wasfia
Roma Wasfiahttps://eracox.com
আমি রুমা ওয়াসফিয়া, একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। পড়াশোনার পাশাপাশি শখের বসে ব্লগিং করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। চেষ্টা করি যোগ-উপযোগী ও মানবসভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত নানান বিষয় নিয়ে বিস্ময়কর কন্টেন্ট তৈরি করতে।কন্টেন্টের মূল উদ্দেশ্য আপনাদের যোগ-উপযোগী নানান কিছু জানানো নানান কিছু শেখানো এবং সর্বোপরি সুশীল সমাজের জন্য ইতিবাচক কিছু করার প্রচেষ্টা।

জনপ্রিয় পোস্ট

লেখকের অন্য পোস্ট

error: Content is protected !!