আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন পথহারা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্যে এবং পৃথিবীর
বুক থেকে সকল অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্যায়, অসত্য, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যাভিচার, শিরক,
কুফর, কুসংস্কার এবং মানব রচিত মতবাদ মতাদর্শের মূলোৎপাটন করে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা বা খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লক্ষাধিক নবী-রাসূল।
তাঁর পরে পৃথিবীতে আর কোন নবী বা রাসূলের আবির্ভাব ঘটবে না। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক নবুয়াতের দরজাকে বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে এ কথা অসত্য নয় যে, প্রত্যেক যুগেই পথহারা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্যে ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ এক বা একাধিক মনীষীর
আবির্ভাব ঘটবে এ ধরাতে।
তাঁরা নবী কিংবা রাসূল হিসেবে আবির্ভূত হবেন না; কিংবা নতুন কোন মত বা মতাদর্শও প্রচার করবেন না। বরং তাঁরা বিশ্বনবী (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে এবং তাঁরই আদর্শের দিকে আহবান করবেন মানব জাতিকে। তাঁদের চরিত্র ও স্বভাব হবে মার্জিত, আকর্ষণীয় ও অনুপম। তাঁরা দুনিয়াকে ভোগ বিলাসের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মনে করবেন না।
তাঁদের চরিত্র, স্বভাবও সাধারণ জীবন যাত্রা দেখে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ফিরে আসবে সত্য ন্যায়ের পথে। ইমাম গাজ্জালী (রঃ)) ছিলেন তাঁদেরই একজন।
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) – আবু হামিদ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ আল-গাজ্জালী।
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর প্রকৃত না আবু হামেদ মোহাম্মদ গাজ্জালী। কিন্তু তিনি ইমাম গাজ্জাল নামেই খ্যাত।
গাজ্জাল শব্দের অর্থ হচ্ছে সূতা কাটা। এটা তাঁর বংশগত উপাধি। কারো মতে তাঁর পিতা মোহাম্মদ কিংবা পূর্ব পুরুষগণ সম্ভবত সূতার ব্যবসা করতেন। তাই উপাধি হয়েছে গাজ্জালী।
তাঁর পিতা ছিলেন দরিদ্র এবং শিশু বয়সেই তিনি তাঁর পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুতে তিনি নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েন কিন্তু সাহস হারাননি। জ্ঞান লাভের প্রতি ছিল তাঁর খুব আগ্রহ।
ইমাম গাজ্জালী’র শিক্ষা জীবন
তৎকালীন যুগের বিখ্যাত আলেম হযরত আহমদ ইবনে মুহাম্মদ বারকানী এবং হযরত আবু নসর ইসমাইলের নিকট তিনি কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ও বিবিধ বিষয়ে অস্বাভাবিক জ্ঞান লাভ করেন।
কিন্তু এতে তিনি তৃপ্তিবোধ করলেন না। জ্ঞান অন্বেষণের জন্যে পাগলের ন্যায় ছুটে যান নিশাপুরের নিযামিয়া মাদ্রাসায়। তৎকালীন যুগে নিশাপুর ছিল ইসলামী জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে সমৃদ্ধও উন্নত। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সর্ব প্রথম ও পৃথিবীর বৃহৎ নিযামিয়া মাদ্রাসা।
সেখানে তিনি উক্ত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুল মালিক (রঃ) নিকট ইসলামী দর্শন, আইন বিবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। আবদুল মালিক (রঃ) এর মৃত্যুর পর তিনি চলে আসেন বাগদাদে। এখানে এসে তিনি একটি মাদ্রাসায় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং বিভিন্ন জটিল বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন।
দেশ দেশান্তরে ইমাম গাজ্জালী
জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শনে তাঁর সুখ্যাতি আস্তে আস্তে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে তিনি আল্লাহকে পাবার জন্যে এবং আল্লাহর সৃষ্টির রহস্যের সন্ধানে ধন-সম্পদ ও ঘর-বাড়ির মায়া মমতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অজানা এক পথে। প্রায় দশটি বছর দরবেশের বেশে ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তর।
আল্লাহর ইবাদত, ধ্যান মগ্ন, শিক্ষাদান জ্ঞান চর্চারমধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেন দিন রাত। জেরুজালেম হয়ে চলে যান মদীনায়। বিশ্বনবীর রওজা মোবারক জিয়ারত শেষে চলে আসেন মক্কায়। হজ্জব্রত পালন করেন। এরপর চলে যান আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে আবার ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞানে ইমাম গাজ্জলী
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছিল অত্যন্ত গভীর। আল্লাহর স্বরূপ ও সৃষ্টির রহস্য তিনি অত্যন্ত নিবিড় ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর মতে আত্মা ও সৃষ্টির রহস্য এবং আল্লাহর অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্কে মীমাংসা করার বিষয় নয়; বরং এরূপ চেষ্টা করাও অন্যায়। আল্লাহর অস্তিত্ব ও সৃষ্টির রহস্য অনুভূতির বিষয়। পরম সত্য ও অনন্তরকে যুক্তি দিয়ে বুঝার কোন অবকাশ নেই।
তাঁর মতে যুক্তি দিয়ে আপেক্ষিকতা বুঝা যায় মাত্র। তিনি সকল প্রশ্নে মীমাংসা করেছেন কোরআন, হাদিস ও তারই ভিত্তিতে নিজের বিবেক বুদ্ধির সাহায্যে।
ধার্মিকতায় ইমাম গাজ্জালী
আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ধর্মের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল পর্বতের ন্যায় অটল ও সুদৃঢ়। ধর্ম ও দর্শনে তাঁর ছিল প্রভূত জ্ঞান। ধর্ম ও যুক্তির নিজ নিজ বলয় তিনি নির্ধারণ করেছেন।
তিনি বলেছেন, “আত্মা কখনো ধ্বংস হয় না কিন্তু দেহ ধ্বংস হয়। আত্মা মৃত্যুর পর জীবিত থাকে হৃদপিণ্ডের সাথে আত্মার কোন সম্পর্ক নেই হৃদপিণ্ড একটি মাংসপিণ্ড মাত্র, মৃত্যুর পরও দেহে এর অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু আত্মা মৃত দেহে অবশিষ্ট থাকে না। মৃত্যুর পর আত্মার পরিপূর্ণ উৎকর্ষ ও মুক্তি সম্ভবপর হয়ে থাকে।”
তিনি ইসলামী জান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন। তিনি ছিলেন ধর্ম, আদর্শ ও সুফিবাদের মূর্তিমান প্রতীক। তিনি অন্ধ বিশ্বাসের উপর যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু যা চিরন্তন সত্য ও বাস্তব সেখানে তিনি যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন না বরং সেক্ষেত্রে ভক্তি ও অনুভূতিকেই প্রাধান্য দিতেন।
ইমাম গাজ্জালী রচিত গ্রন্থসমূহ-
(১) ইহিল-উল-উলমুদ দীন,
(২) কিমিয়াতে সাদাত-এ গ্রন্থটি ক্লড ফ্লিড The Alchemy of happiness নাম দিয়ে ইংরেজি ভাষার অনুবাদ করেন। এ গ্রন্থটি সৌভাগ্যের পরশ মণি’ নামে বাংলা ভাষায়ও অনূদিত ও বহুল প্রচারিত হয়ে আছে,
(৩) কিতাবুল মনফিদলিন আদ দালাল- এ গ্রন্থটি The liberation Fromerror নাম দিয়ে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে,
(৪) কিতাবুত তাকাফাতুল কালাসিফা এ গ্রন্থটি ক্লড ফিল্ড The Internal Contradiction of philosophy নাম দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন,
(৫) মিশকাতুল আনোয়ার,
(৬) ইয়াকুত্তাবলিগ,
(৭) মনখুল
প্রভৃতি গ্রন্থ সমগ্র ইউরোপে সমাদ্রিত হয় এবং আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ মহামনীষী ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ইসলামের এক নব জাগরণ ঘটিয়েছিলেন।
ইমাম গাজ্জালী’র অমূল্য বাণী-
“মানুষের জ্ঞাতসারে যে কাজ করতে লজ্জাবোধ কর, গোপনে সেরূপ কাজ করতে চেষ্টা করো না।” -ইমাম গাজ্জালী (রঃ)।
“অপবিত্র কাপড় প্রস্রাব দ্বারা ধৌত করে পাক করার চেষ্টা, আর হারাম মাল দ্বারা সদকা করতঃ পূর্ণ অর্জন করার আশা করা একই পর্যায়ভুক্ত।” -ইমাম গাজ্জালী (রঃ)।