Monday, 23-December, 2024
Homeবিশ্ব ও ইতিহাসজীবনীওমর খৈয়াম - গিয়াস উদ্দিন আবুল ফতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম নিশাপুরি।

ওমর খৈয়াম – গিয়াস উদ্দিন আবুল ফতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম নিশাপুরি।

ওমর খৈয়াম (১০৪৪-১১২৩ খ্রিঃ) ওমর খৈয়াম ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসানের রাজধানী নিশাপুর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম গিয়াস উদ্দিন আবুল ফতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম আল-খৈয়াম নিশাপুরি। কিন্তু তিনি ওমর খৈয়াম নামেই সমগ্র অর্থ হচ্ছে তাবু নির্মাতা বা তাবু ব্যবসায়ী। সম্ভবত বংশের কেউ তাবু নির্মাণ করতে কিংবা তাবুর ব্যবসা করতেন। আর সেই থেকেই বংশের কিংবা পারিবারিক উপাধি হয়েছে খৈয়াম।

আসলে তিনিই ছিলেন খৈয়াম অর্থাৎ তাবু নির্মাতা। তিনি জ্ঞানের যে তাবু নির্মাণ করে গেছেন, আজও বিশ্বের অগণিত জ্ঞান পিপাসু মানুষ প্রবেশ করে জ্ঞানের সে তাবুর অভ্যন্তরে এবং আহরন করে জ্ঞান। ওমর খৈয়ামের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। এমন কি এ মনীষীর জন্ম তারিখ নিয়েও রয়েছে মতভেদ। পারস্য ঐতিহাসিকগণের মতে গজনীর সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে আনুমানিক ১০১৮ থেকে ১০৪৮ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিশ্ব বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, অংক শাস্ত্রবিদ, জ্ঞান অর্জন করার তেমন কোন আশা আকাঙ্খা তাঁর ছিল না। তিনি কেবল মাত্র আত্মসন্তুষ্টির জন্যে বিজ্ঞান চর্চার অবসর সময়ে মনের খেয়ালে এক ধরণের চতুষ্পদী কবিতা লিখতেন। তিনি নিজ মাতৃভূমি ইরানেও জীবিতাবস্থায় কবি হিসাবে পরিচিত ছিলেন না। অথচ মনের খেয়ালে তাঁর লিখিত কবিতাগুলো আজ সমগ্র বিশ্বে হয়েছে সমাদ্রিত এবং দখল করেছে সাহিত্য ও কবিতা জগতের শ্রেষ্ঠ সিংহাসন। ওমর খৈয়াম আজ সমগ্র বিশ্বের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ইউরোপীয়রা অত্যন্ত কৌশলে এ মনীষীকে বিশ্ব বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর পরিবর্তে কেবলমাত্র একজন কবি হিসাবে পৃথিবীর মানুষের সামনে পরিচিত করার চেষ্টা করেছেন। ওমর খৈয়ামের মৃত্যু প্রায় ৭৩৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে এডোয়ার্ড ফিজারেল্ড খৈয়ামের ‘রুবাইয়াত’ নামক চতুষ্পদ কবিতাগুলোর ইংরেজী অনুবাদের দ্বারা সমগ্র ইউরোপ তাঁর রুয়াইয়াত ছড়িয়া দেয় এবং তিনি কবি হিসাবে পরিচয় লাভ করেন।

ওমর খৈয়াম ছোট বেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধামী ও বুদ্ধিমান। তাঁর স্মরণ শক্তি এত প্রখর ছিল যে, যে কোন দর্শন গ্রন্থ এবং কঠিন কঠিন কিতাব সমূহ মাত্র ৬/৭ বার পাঠ করেই তা মুখস্ত করে ফেলতেন। তাঁর মেধা ও প্রতিভার সামনে সক্রেটিস, এ্যারিষ্টটল, এবং ইউক্লিড এর প্রতিভাও ম্রিয়মান হয়ে যায়। ওমর খৈয়ামের শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত পন্ডিত ইমাম মোয়াফিক। মনীষী ওমর খৈয়ামের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না। আমীর আবু তাহির তাকে জ্ঞান চর্চার জন্যে কিছু অর্থ সাহায্য করেন এবং রাজ্যের সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ফলে তাঁর আর্থিক দূরাবস্থা সামান্য লাঘব হয়। রাষ্ট্রীয় সাহায্য পেয়ে ওমর খৈয়াম ভোগ বিলাসকে স্পর্শও করেননি। বরং রাষ্ট্রীয় সাহায্য তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান সাধনা ও গবেষণার কাজে সহায়তা করেছিল। কোন বই হাতে পেলেই তা তিনি পড়ে শেষ করে ফেলতেন।

জ্যোতিবিজ্ঞান, বীজ গণিত ও জ্যামিতি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। এছাড়া দর্শন শাস্ত্রে ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি। মানুষ হিসেবে ছিলেন তিনি খাঁটি মুসলমান ও আল্লাহ প্রেমিক।
এ জালালী বর্ষপঞ্জীতে ৩৭৭০ বৎসরে মাত্র ১ দিনের ভ্রান্তি ছিল। অপর দিকে গ্রেগরীয়ান বর্ষপঞ্জীতে ভ্রান্তি ছিল ৩৩৩০ বৎসরের ১ দিনের। জালালী অব্দ হিজরী ৪৭১ সালের ১০ রমজান থেকে শুরু হয়। এ মহান বিজ্ঞানী একটি নতুন গ্রহও আবিষ্কার করেছিলেন। ওমর খৈয়ামের সর্বাধিক অবদান এলজাবরা অর্থাৎ বীজ গণিত।

তিনিই সর্বপ্রথম এলজাবরার সমীকরণগুলোর শ্রেণী বিন্যাসের চেষ্টা করেন। জ্যামিতি সমাধানে বীজগণিত এবং বীজগণিত সমাধানে জ্যামিতি পদ্ধতি তাঁরই বিস্ময়কর আবিষ্কার। ভগ্নাংশীয় সমীকরণের উল্লেখ ও সমাধান করে ওমর খৈয়ালই সর্ব প্রথম বীজগণিত এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। বীজগণিত সম্পর্কীয় ফি আলজাবারে নামক গ্রন্থ তিনিই রচনা করে যান। বীজ গণিতের ক্ষেত্রে ‘বাইনোমিয়াল থিউরাম’ আবিস্কার করেন। এই ‘বাইনোমিয়াল থিউরাম’ এর আবিষ্কার কর্তা হিসাবে বৈজ্ঞিানিক নিউটন আজ পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছেন। অথচ তারও শত শত বছর পূর্বে কবি হিসাবে পরিচিত বৈজ্ঞানিক ওমর খৈয়াম তা আবিষ্কার করে গেছেন। গণিত শাস্ত্রেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম।
গণিত জগতে এলালিটিক জিওমেট্রির কল্পনা তিনিই সর্বপ্রথম করেন।

সমকালীন আরেক মহান মনুষী ইমাম গাজ্জালী। পড়ুন বিস্তারিতঃ- 

পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে জনৈক গণিতবিদ একে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয় মাত্র। এছাড়া পদার্থ বিজ্ঞানেও তাঁর অবদানের কোন কমতি নেই। ওমর খৈয়ামকে মেধা ও চিন্তা শক্তি এত গভীর ছিল যে, একদিন ইমাম গজ্জালী (রহঃ) ওমর খৈয়ামকে প্রশ্ন করেছিলেন, কোন গোলক যে অংশের সাহায্যে অক্ষের উপর ঘুরতে থাকে, গোলকের সমস্ত অংশ এক প্রকার হওয়া সত্ত্বেও ঐ অংশটি অন্যান্য অংশ থেকে কিভাবে আলাদা রূপে জানা সম্ভব?

এ প্রশ্নের জবাবে ওমর খৈয়াম তখনই অংকের ব্যাখ্যা শুরু করেন। দুপুর থেকে করে বিকেল পর্যন্ত ও তার ব্যাখ্যা শেষ হয়নি। তাঁর জবাবে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “সত্যের সন্ধান পেতে মিথ্যার যবনিকা অপসারিত হলো। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে আমার ধারনা ছিল তা মিথ্যা।”

ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বহু বহু রচনা করে যান। ওমর খৈয়াম যে এত বড় দার্শনিক, বিজ্ঞানী, অংক শাস্ত্রবিদ ও চিকিৎসাবিদ ছিলেন তা মুসলিম জাতির অনেকেই হয়তো আজও জানেন না। কেবল মাত্র একজন কবি
হিসাবেই তাঁকে সবাই জানেন। এ অসাধারণ ব্যক্তিটিকে তাঁর জীবিতাবস্থায় নিজ মাতৃভূমিরবলোকেরাও চিনত না কিংবা চিনার চেষ্টা করতো না।

আরও পড়ুনঃ- ইবনে রুশদ – মুসলিম বিশ্বের এক অমূল্য রত্ন।

ওমর খৈয়াম কখনো নিজকে জনগণের সামনে জাহির করার চেষ্টা করেননি। তাঁর মত বহু মুসলিম মনীষী নিজের ব্যক্তিত্বকে লুকিয়েবরেখে সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণে জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যে অবদান রেখে গেছেন।

তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু তার অধিকাংশ গ্রন্থই সংরক্ষণের অভাবে আজ হারিয়ে গেছে। তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রস্থ হচ্ছে –
(১) রুবাইয়অত (মরমী কবিতা)
(৩) নিজাম-উল-মূলক (রাজনীতি)
(৫) মুশফিলাত (গণিত শাস্ত্র)
(২) মিজান-উল-হিকাম (রসায়ন কবিতা)
(৪) আল জাবরা ওয়াল মুকাবিলা (বীজগণিত)
(৬) নাওয়াযিম আসকিনা (ঋতু পরিবর্তন বিষয়ক)
(৭) আল কাউল ওয়াল তাকলিক (মানুষের নৈতিক দায়িত্ব)
(৯) দার ইলমে কুল্লিয়াত
(৮) রিসালা মুকাবাহ
(১০) নওরোজ নামা প্রভৃতি।

বিশ্ব বিখ্যাত এ মনীষী ১১২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৭৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। জানা যায়, মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর শিষ্যদের শেষ বারের মত বিশেষ উপদেশ দানের উদ্দেশ্যে আহ্বান করেন। এরপর তিনি ওজু করে এশার নামাজ আদায় করেন। এদিকে তিনি শিষ্যদের উপদেশ দানের কথা ভুলে যান। নামাজান্তে সেজদায় গিয়ে তিনি কাঁদতে থাকেন এবং জোরে জোরে বলতে থাকেন, হে আল্লাহ আমি কেবল মাত্র তোমাকে পাবার এবং তোমাকে সন্তুষ্ট করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমি চাই তোমাকে। হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তোমার দয়া ও করুণার গুণে আমাকে ক্ষমা করে দাও”। এরপর তিনি আর মাথা তোলেননি। সেজদা অবস্থায়ই তিনি চিরদিনের জন্য এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Sazzat Hj
Sazzat Hjhttps://eracox.com/
আমি সাজ্জাত, অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। কাজ করি এড্রোয়েড এপ্লিকেশন নিয়ে। বর্তমানে শখের বসে ব্লগিং করতে ক্ষুদ্র চেষ্টা। চেষ্টা করি যোগ-উপযোগী ও মানবসভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত নানান বিষয় নিয়ে বিস্ময়কর কন্টেন্ট তৈরি করতে।কন্টেন্টের মূল উদ্দেশ্য আপনাদের যোগ-উপযোগী নানান কিছু জানানো নানান কিছু শেখানো এবং সর্বোপরি সুশীল সমাজের জন্য ইতিবাচক কিছু করার প্রচেষ্টা।

জনপ্রিয় পোস্ট

লেখকের অন্য পোস্ট

error: Content is protected !!