ড্রাগন ফল এটি এক প্রজাতির ফল, একধরনের ফণীমনসা (ক্যাক্টাস) প্রজাতির ফল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এর মহাজাতি হায়লোসিরিয়াস (মিষ্টি পিতায়য়া), এই ফল মূলত ড্রাগন হিসেবে পরিচিত। চীন-এর লোকেরা এটিকে আগুন ড্রাগন ও ড্রাগন মুক্তার ফল বলে থাকে, ভিয়েতনামে মিষ্টি ড্রাগন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে ড্রাগন ফল, থাইল্যান্ডে ড্রাগন স্ফটিক নামে পরিচিত। অন্যান্য স্বদেশীয় নাম হলো স্ট্রবেরি নাশপাতি বা নানেট্টিকাফল। এই ফলটি একাধিক রঙের হয়ে থাকে। তবে লাল রঙের ড্রাগন ফলটি বেশি দেখা যায়।
রুপচর্চা ও স্বাস্থ সেবায় পুদিনা পাতা
বিদেশি ফল হলেও ড্রাগন ফলের সতেজ করা স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য বাংলাদেশে সু-পরিচিত বর্তমানে এই ফল চাষও হচ্ছে। পুষ্টিগুণ কমলা বা গাজরের চাইতে বেশি। পাহাড়ি জনপদে ড্রাগন ফলের আবাদ বেশ বেড়েছে । এই ফলের চাহিদাও রয়েছে বেশ। বাগানে এই ফল ৩০০–৪০০টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও শহরে প্রতি কেজি আরও বেশি। ড্রাগন ফলের ভেতরটা যেমন রাঙা, খেতেও সুস্বাদু।
কেন এ ফলের নাম ড্রাগন?
ড্রাগন ফল দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর। পাতাবিহীন এই ফলটি দেখতে ডিম্বাকার ও লাল রঙের। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই ফলের বাইরের খোসা দেখতে রূপকথার ড্রাগনের পিঠের মতো। এই রূপকথার ড্রাগনের মতো কিছুটা মিল থাকার ফলে একে ড্রাগন ফল বলা হয়।
ড্রাগন গাছ দেখতে কেমন?
বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয়, হালকা মিষ্টি-মিষ্টি। এই ফলের খোসা নরম এটা কাটলে ভিতরটা দেখতে লাল বা সাদা রঙের হয়ে থাকে এবং ফলের মধ্যে কালজিরার মতো ছোট ছোট নরম বীজ আছে। নরম শাঁস ও মিষ্ট গন্ধ যুক্ত গোলাপি বর্ণের এই ফল খেতে অনেক সুস্বাদু। গাছ ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার হয়।
রাতের রানি ড্রাগন ফুল
ড্রাগন গাছে শুধুমাত্র রাতে ফুল দেয়। ফুল লম্বাটে সাদা ও হলুদ রঙের হয়। দেখতে ‘নাইট কুইন’ ফুলের মত। আর এই কারণে ড্রাগন ফুলকে ‘রাতের রাণী’নামে অভিহিত করা হয়। ড্রাগন ফলের গাছ লতানো ইউফোরবিয়া গোত্রের ক্যাকটাসের মত কিন্তু এর কোন পাতা নেই। ফুল স্বপরাগায়িত; তবে মাছি, মৌমাছি ও পোকা-মাকড় এর পরাগায়ণ ত্বরানবিত করে এবং কৃত্রিম পরাগায়নও করা যায়। ড্রাগন ফুলকে বলা হয় ‘মুন ফ্লাওয়ার’বা ‘কুইন অব দ্য নাইট’। ফুল থেকে ডিম্বাকার ফল গঠিত।
ড্রাগন ফলের উপকারিতা
এই ফল দেখতে খুব আকর্ষনীয়, এর কার্যকারিতা ও সুফলতা অনেক বেশি। এশিয়ার মানুষের কাছে এ ফল অনেক জনপ্রিয়, হালকা মিষ্টি-মিষ্টি, কোনোটা আবার হালকা টক।
ক) ড্রাগন ফলে ক্যালোরির পরিমাণ খুব কম থাকে। তাই ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীরা খেতে পারবেন।
খ) ড্রাগন ফলে ভিটামিন সি বেশি থাকার ফলে এই ফল খেলে আমাদের শরীরের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ হয়। লাল শাঁসের ড্রাগন ফলে বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে।
গ) ড্রাগন ফলে প্রচুর আয়রন থাকার কারণে রক্ত শূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে।
ঘ) ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমানে পানি থাকার ফলে এই ফল জুস আকারে খেলে শরীরের পানি শূন্যতা সহজেই দূর হয়।
ঙ) নিয়মিত ড্রাগন ফল খেলে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই এই ফল ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উত্তম।
চ) ড্রাগন ফলের শাঁস পিচ্ছিল হওয়ায় এই ফল খেলে কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর হয়।
ছ) ড্রাগন ফলে প্রচুর ফাইবার থাকে যা পেটের পীড়া এবং লিভার এর জন্য ভালো।
জাত
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফলভাবে চাষ করার জন্য বাউ ড্রাগন-ফল–১ (সাদা), বাউ ড্রাগন-ফল–২ (লাল) নির্বাচন করা যেতে পারে। এ ছাড়া হলুদ ড্রাগন-ফল, কালচে লাল ড্রাগন-ফল চাষ করা যেতে পারে। দুটি জাত বাংলাদেশে চাষ করা হচ্ছে।
উপযুক্ত সময়
ড্রাগন ফল সাধারণত সারা বছর-ই চাষ করা যায়। এটি মোটামুটি শক্ত প্রজাতির গাছ হওয়ার ফলে প্রায় সব ঋতুতেই চারা রোপন করা যায়। তবে ছাদ বাগানে ড্রাগন ফলের চাষ করে ভালো ফলন পেতে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে চারা রোপন করলে সুফল পাওয়া যায়।
চারা উৎপাদন
বীজ ও কাটিং পদ্ধতিতে ড্রাগন ফলের চাষ করা যায়। তবে বীজের গাছে মাতৃগাছের মতো ফলের গুণাগুণ না-ও থাকতে পারে। এতে ফল ধরতে বেশি সময় লাগে। ড্রাগন চাষের জন্য কাটিং চারাই বেশি উপযোগী। কাটিং থেকে উৎপাদিত গাছে ফল ধরতে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগে। উপযুক্ত যত্ন নিলে একর প্রতি ৬ থেকে ৭ টন ফলন পাওয়া যায়।
ছাদ বাগানে ড্রাগন চাষ
ড্রাগন ফলটি জমির পাশাপাশি বাড়ির ছাদেও চাষ করা য়ায়। দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আবাদের জন্য বাউ ড্রাগন-১ (সাদা), বাউ ড্রাগন-২ (লাল), হলুদ ও কালচে লাল ড্রাগন ফলে চাষ বাড়ানো যেতে পারে। খেতে সুস্বাদু পুষ্টিকর এ ফলের চাষ ব্যাপকভাবে গড়ে উঠলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ড্রাগন ফল বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব বলে কৃষিবিদরা মনে করছেন।
পাহাড়ে ড্রাগন চাষ
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিদেশী ফল হলেও পাহাড়ের জলবায়ু এবং মাটি দুটিই ড্রাগন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পাহাড়ে ড্রাগন ফলের চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের মতে, পাহাড়ের মাটি এই ফল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে এই ফলের ব্যাপক চাষাবাদ সম্ভব। পাহাড়ে বাড়ছে বিদেশি ফল ড্রাগনের চাষ।
পোকামাকড়ের আক্রমণ কম এবং পানির সেচ কম লাগায় এ চাষে আগ্রহী হচ্ছে পাহাড়িরা। স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় বান্দরবানে জুমচাষ ছেড়ে ড্রাগন ফলের চাষের দিকে ঝুঁকছেন পাহাড়িরা। জানা গেছে, চিম্বুক পাহাড়ের বসন্ত পাড়ায় বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ করে লাভবান হয়েছেন তারা।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ড্রাগন চাষ
খরাপ্রবণ এলাকা হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চলে খরাসহিষ্ণু ক্যাকটাস প্রজাতির এ ফলের ফলন ভালো হওয়ায় ‘ড্রাগন’ চাষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রাজশাহীর কিছু অঞ্চলে স্থানীয়দের মধ্যে অপরিচিত এ ফল চাষ করা হয়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সীমিত পরিসরে রাজশাহী অঞ্চলে ড্রাগন ফলের আবাদ শুরু হয়েছে। বিঘাপ্রতি খরচ পড়ছে প্রায় ২ লাখ টাকা আর বছরে আয় প্রায় ৫ লাখ টাকা।
ড্রাগন ফলের ব্যবহার
এ ফল কাঁচা বা পাঁকা অবস্থায় খাওয়া যায়। তবে পাকা ফল ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে খেলে বেশ ভালো লাগে। ফলকে লম্বালম্বিভাবে কেটে ২/৪ টুকরা করে চামচ দিয়ে কুরে এর শাঁস খাওয়া যায়। এ ছাড়াও খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে খাওয়া যায়। এটা মুলত ফ্রুট সালাদ হিসেবে, মিল্ক শেক তৈরিতে, জুস তৈরির জন্যও ফলটি অত্যন্ত উপযোগী। এর ফুলও খাওয়া যায়।
ড্রাগন ফলের পুষ্টি উপাদান
এ ফলটি প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, মিনারেল এবং উচ্চ ফাইবার যুক্ত। জুস তৈরীর জন্যও ফলটি অত্যন্ত উপযোগী। ড্রাগন ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ ঠিক রাখার জন্য সাধারণত এটি কাঁচা অবস্থাতেই খাওয়া ভাল।
প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলের সাদা/লাল অংশে প্রায় ২২ মি.গ্রা. ভিটামিন সি পাওয়া যায় যা একজন মানষের দৈনিক ভিটামিন সি’র চাহিদার ৩৪ শতাংশ পূরণ করে।
১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে যে পরিমাণ ভিটামিন সি পাওয়া যায় তা একটি কমলা বা তিনটি গাজরের বেশি ভিটামিন সি সরবারহ করতে সক্ষম। ভিটামিন সি’র মাত্রা বেশি থাকায় ড্রাগন ফলটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়,সাথে মানসিক অবসাদ দূর করে এমন কি ত্বক সুন্দর রাখতে সাহায্য করে।
প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ৩ গ্রাম আঁশ থাকে যা দৈনিক চাহিদার ১২ শতাংশ। ড্রাগন ফলের আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিকারক হিসেবে কাজ করে।
ড্রাগন ফলের বীজে থাকে ল্যাক্সেটিভ ও পলিআনস্যাচুরেইটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যা হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধের সহায়ক।
প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে জলীয় শতাংশ থাকে প্রায় ৮৭ গ্রাম, প্রোটিন ১.১ গ্রাম, ফ্যাট ০.৩ গ্রাম বলতে গেলে ফ্যাট নাই বললেই চলে এবং কার্বোহাইড্রেট আছে ১১.০ গ্রাম।
তাছাড়া এতে বেশ কিছু ভিটামিন ও খনিজ উপদান যা মানবদেহের সুস্থতার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ভিটামিন বি-১ ০.০৪ মিলিগ্রাম,ভিটামিন বি-২, ০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-, ০.০১৬ মি.গ্রা এবং ২০.০৫ মি.গ্রা. সি পাওয়া যায়।
ড্রাগন ফলে আছে আয়রনের ভালো উৎস। ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ১.৯ মি.গ্রা. আয়রন থাকে। এছাড়াও এতে ক্যালসিয়াম থাকে ৮.৫ মি.গ্রা. এবং ফসফরাস থাকে ২২.৫ মি.গ্রা.।